ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ ভাদ্র ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

প্রত্যাবর্তনের প্রেমাংশ


প্রকাশ: ১০ জুলাই, ২০২০ ১৪:০০ অপরাহ্ন


প্রত্যাবর্তনের প্রেমাংশ

   

শহিদুল ইসলাম : আমি তোমার গোমর কাব্য যতবারই পড়েছি, ততবারই ঠাঁই হয়ে দ্বিধান্বিতর দাগ কেটেছে মনের হৃদপিণ্ডের প্রদেশে! সূর্যের ললাটে লাল আভাটা গোধূলি বেশে ধূসর আকাশে যতটা প্রাণোচঞ্চল  দেখায়, তেমনি শুরুটা আমিও দেখেছিলাম পৌঢ় ষোড়শীর কোপাই ছিল কয়েক গুচ্ছ শিউলিফুলের আড়ৎ এবং দুধে-আলতা রঙের  হাতে বেশ হরেকরকমের নীলাভ চুড়ি, পায়ে লেপ্টে ধরেছে আলতার বাহারি কিংবা পায়েলের হুংকার! সে যৌবনের যতোটা রুপের কান্ডারী ছিলেন।

তাঁর চেয়ে ঢের বেশি ছিলেন ছলনাময়ীর রুপোলীর প্রসাদ। আমি বিস্মৃত হয়েও কখনো রূপের শহরে হন্য হয়ে তাকে খুঁজে নি, বরঞ্চ চেয়েছিলুম মনের মধ্যে মণিদীপা হয়ে বেঁচে থাকুক আমারে প্রার্থনা শহুরে। সেও কি চেয়েছিল প্রার্থনা শহুরে উন্মুখতা হয়ে প্রবেশ হতে।

সে উন্মুখতা হয়ে একদিন আমার এক অদৃষ্টের প্রার্থনা শহুরে এসেছিল আষাঢ়ের শ্রাবণের এক গগনের ধারায় বর্ষায়। তবে সে দিনের দিনক্ষণ ঠিক মোর মনে ছিলো না। কিন্তু সেই দিনের শহরটা ছিলো এক ধূসর মেঘাচ্ছন্ন ঘোলাটে আকাশ, যেখানে গাংচিলরা বিমুখতা হয়ে মনের অবরুদ্ধ এক শহর থেকে অন্য শহরে হয়ে প্রাণপণ ছুটে বেড়াচ্ছিল। 

যেন স্বজনরা হারিয়ে গেলে মানুষরা ঝটপট করতে থাকে ঠিক তেমনিভাবেই গাংচিলরা খুব অভিমানী হয়ে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত আত্মতৃপ্তির নিবাস কুঞ্জে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। সে ষোড়শী রমনী আমার শহুরে আগমনে ক্রোধান্বিত ঘোলাটে আকাশটার দেয়া অঝোর এক পশলা বৃষ্টিতে যেন শহুরটা নিস্তব্ধতা নির্জীবে সজীবতার পরিপক্বতার পরিপুষ্ট হয়ে এক নতুন শহর ফিরে ফেলো।

সে দিনক্ষণে তার ছিপছিপে গড়নের  শরীরে পরিধানে ছিলো গাঢ় খয়েরী রঙের ব্লাউজের সাথে কুচি দিয়ে পড়ানো পাতলা নীলাভ শাড়ী তার সাথে ওষ্ঠে ছিলো গাঢ় খয়েরী লিপস্টিকে কিঞ্চিৎ এক চিলতে মৃদু হাসি। আর কানে ছিল হলদে ভাবের কানের দুল, নাকে ছিলো এক রত্তি এক নোলক। এলেমেলো রেশমী কালো কেশগুলো প্রাণোচঞ্চোল হয়ে অবাধ্যতার মত চক্ষুগুলোকে বারবার অন্ধকারে ঢেকে দিচ্ছে।

এসব কিছুই যেন তার রূপের কান্ডারীকে আরও ফুটিয়ে তুলতে প্রাণপন চেষ্টা করতেছে । প্রিয়তুর সাথে এই শেষ দর্শনে আমি হতবিহ্বল হয়ে খানিকক্ষণ বাকরূদ্ধতার প্রতীক হয়ে তাহার পানে কিংকর্তব্যবিমুঢে তাকিয়ে ছিলাম। প্রিয় লেখক শরৎচন্দ্রের চট্রোপাধায়ের মতে ওষ্ঠে এক চিলতে মৃদু হাসির রেখা টেনে তাহার পানে বললাম, "বহুকাল বৃষ্টি হবার পরে,যেমন সূর্যের পানে তাকাতে নেই। তাকালেই চক্ষুপীড়া হয়,ঠিক তেমনি আমারও হচ্ছে ,আঁচলে মুখটি ঢাক। বিচলিত হয়ে লজ্জাবর্তীর পাতার ন্যায় খানিকক্ষণ তার মুখটি আড়াল করে নিল আমার অগোচরে। 

আমিও বেশ ক্লেশহীন ভাবে চক্ষুদীপা মেলিয়া তার অগোচরে মনের দর্শনে  খুব পাকাপোক্তভাবে উদ্দীলিত হয়ে ঠাঁই খুঁজেতেছিলাম তার মনের স্থায়ী বাসিন্দা হতে। খুব বেশি কি চেয়েছিলাম। জানি না, মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করলাম না। খারাপ জিনিস যতটা মস্তিষ্কে জায়গা নেয়,ভালো ততটা পাই না। তখন মনে হয়েছিল যেন জন্ম-জন্মান্তর তাকে আমার চাই।  আর আমার চিন্তার ব্যাঘাত ঘটিলো তার কথার আলৌকিকতায়।

আমি হকচকিয়ে কিংবা কিংকর্তব্যবিমুঢে চক্ষু নিলম্বিত রেখে বলিলাম হু।" রমনীর ধীর স্থিরচিত্রে শান্তভাবে বলিত লাগিল, "কত কাল দেখেনি তোমায়, কেমন আছো?? যেন খরার কাঠানো মরুভূমিটা এক পশলা বৃষ্টিতে দাবানলের ন্যায় উদ্দামে উদগীরণ হতে লাগিল মনে শীতল হাওয়া। আমি প্রলুপ্ত বাক্য বললাম, হুমম,বেশ আছি।যেভাবে শেষটায় তুমি রেখে গিয়েছিলে আমাকে নির্জীব দ্বীপে নির্বাসন দিয়ে।"

সে মৃদুস্বরে বলিল, পূর্বের ন্যায় একালেও আমার প্রতি তোমার অভিযোগের নীল  চিরকুটটা বিলুপ্তি ঘটে নি? কেন এত স্বচ্ছতা তোমার?  তোমাকে রেখে যাওয়াতে আত্মা দগ্ধ হয়েছি বহুবার। একদিকে তোমার দেওয়া সময়ের আত্মাগ্লানি নেওয়া অন্যদিকে প্রতিনিয়ত ভুলের উদগ্রীব হয়ে উদগীরণ হওয়া বাষ্পীয় গুলো আমাকে নিপাতিত করেছে ক্ষণকালের প্রদীপ্ত হতাশার লীলা শিখায়।

এসবই আজ থাক! আবার ছন্নছাড়া কোন এক তপ্তময় শহরে বেখেয়ালিতার জড়তায় বিমূর্ত বিমর্ষে নয়নে আবদ্ধ হয়ে কপি হাউজের রদ্ধাশ্বাস আড্ডায়। সে দিন না হয় তোমার ঘাড়ে মাথা নেতিয়ে বলিব আমার আত্মক্ষরণের না বলার গল্প। এখনও কি উপেক্ষায় রেখে দিবে আমার জিজ্ঞেসার উত্তর?? 


অপ্রতিভ হয়ে আমি বলিলাম, কালের বিবর্তনে পূর্বের ন্যায় ঢের ভালো আছি। (পূর্বে রমনীকে এরকম অনুতপ্ততার উদাস্থ হয়ে মনের বাহুডোরে  এভাবে সর্ম্পন করিবে কম্বিন কালেও ভাবে নি।তার ললাটে চক্ষুতে আমি স্পষ্ট হয়ে দেখতে পেরেছিলাম যেন শরানার্থী হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছিল এপাড়ে-ওপাড়ে।  ঠাঁই নেই তার অন্তরঙ্গনে কিংবা বহিরঙ্গনে।  এই বুঝি প্রকৃতি তার হিসাবটা নির্দয়ভাবে নিকাশ করেছে। 

ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে ফের বলিলাম, জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচা যায় না। এতে দুঃখ ভার ঘটে।  এসব নিয়ে বাঁচতে হয়। যাওয়ার কালে কত প্রাণোঞ্চল? আর ঐসব কোথায় নরকীয় দম্ভ? মুক্ত করে দিবে আমায় বিনিদ্রায় বিমোহিত হওয়া অক্ষিকোটরের ললাটে নয়নের ক্ষুব্ধতার বুলিগুলোর রজনী গুলো?  ফিরিয়ে দেবে কি ছেড়ে যাওয়ার কালে নিম্নাভিমুখীর নিলম্বিত অশ্রুপাতগুলো? বিষ বাষ্পীভূত নিকোটিনের কালো ধুঁয়াগুলো ফুসফুস থেকে মুক্ত দিতে পারবে? মস্তিষ্কের নিউরনে আবছা-আবদ্ধ হয়ে নিস্তব্ধতার নির্জীবে গোমর হয়ে আছে কত কথা। 

আমি এসবের মুক্তি চাই,পারবে?? রমনীর নির্লিপ্তে বচন ভঙ্গিতে যা জানিলাম তা হল, সে মৃদু অনুতপ্ত। অথচ আমার নিউরনে ক্ষনে ক্ষনে ক্ষুব্ধতার প্রলয় জলোচ্ছ্বাস হচ্ছে আর বিক্ষিপ্ত উগ্রস্বরে বলিলাম, কনিষ্ঠ আঙুলে জোড়াবদ্ধ হয়ে তার সাথে প্রকৃতি নিয়মে চলে যাওয়াটার কারণ কি?? (এসব প্রশ্নে আমার প্রাণোচছ্বাস হলো। 

মনের মতো প্রকৃতিটা ও বেজায় সেজেছে আমার প্রশ্নে উদ্দীপিত হয়ে। মনের শহরটার আবছা আবহ মেঘটা ক্রমান্বয়ে উপেক্ষিত হয়ে, যেন নবপল্লব রাশিতে স্বপ্রাণে পাতা রন্ধ্রে হয়ে আমার কার্বন গুলো গ্রহণ করতেছে সে)

আমি স্পষ্ট স্বরে শুনতে পেলাম, মনের পর্দাবৃত দেয়ালের ওপার থেকে থেকে সে বিড় বিড় করে বলতেছেঃ-ঠাঁই হবে তোমার চরণে শেষ নিশ্বাস অবধি? ঠাঁই হলে  তোমার অন্দরমহলে পুরোহিত ক্রীতদাসী হয়ে কাটিয়ে দিবো আমার সারাটা জনম!!

রমনী বিমর্ষচিত্তে সুরেলা কণ্ঠে মৃদু স্বরে বলিলঃ- ক্ষমাট অযোগ্য প্রেমিকা হিসেবে নিরাশ করে ছুঁড়ে ফেলে দিও না নির্বাসনের বৃদ্ধাশ্রমে! প্রায়শ্চিত্তে সুযোগ দিলে এই জনমে না হয়, অন্য জনমে হয়ে ভালোবাসার কান্ডারী হয়ে তোমার মনের চারণভূমিতে বসবাস করিবো। পথভ্রাষ্ট পথিকের ন্যায় অনুতপ্ত হয়েছি বহুবার! হন্য হয়ে খুঁজেছি তোমায় পাবার মাদকতায়! আমার দেয়া রিক্ততার বিমর্ষ দিবসগুলো জলাঞ্জলি দিয়ে, আমায় আবার ফিরিয়ে নিয়োও আমায়।

দেবে কি ঠাঁই মনের প্রসাদের দর্পন হতে? এসব বাদ দিয়ে হলেও স্মৃতির করজোড়ে আমায় গ্রহণ করিও তুমি! তোমার উত্তরের উচ্ছ্বসিত হতে চাই আমি,চাই না কালো মেঘের বর্ষনে ভেলায় বেড়াতে! আমি আবার আসিবো ফিরে তোমার উত্তরের আঁচ ফেলাতে কোন রৌদ্দুরে। রমনী এই বলিয়ে প্রস্থান করিল।

প্রস্থান কালে অপলক নয়নে দৃষ্টিপাত করিয়ে উদগ্রীব হয়ে ভাবিতে লাগিলা,  ঠাঁই হবে! তবে শর্তসাপেক্ষে। ফিরতি দেখা হলে বিশারদ আলোচনা হবে ভালোবাসার চালশে নিয়ে! থাক আজ এতটুকু।

লেখকঃ
শহিদুল ইসলাম 
ইসলামিয়া ডিগ্রি কলেজ (সদর ঘাট) 
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়


   আরও সংবাদ