প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০২১ ১২:৩২ অপরাহ্ন
যশোর থেকে খান সাহেব : চলমান করোনা সংকট এবং বিক্রির বাজার সংকীর্ণ হওয়ায় দুধের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হওয়ায় আর্থিক সংকটে রয়েছে যশোর জেলার তিন হাজার ডেইরী খামার। এর মধ্যে যশোরে সমিতিভুক্ত বড় ৪০টিসহ শতাধিক খামার রয়েছে হুমকিতে। শ্রমিক মজুরি ও পশু খাদ্যের দাম বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে বিক্রির বাজার বাড়ছে না। বরং সংকীর্ণ বিক্রি বাজারের কারণে জেলায় প্রতিদিনই প্রায় ৫০ হাজার লিটার দুধ বানে রেখে দেয়া হচ্ছে।
এছাড়া সরকারি হিসেব মতে জেলায় ৩ হাজার ৩২টি খামার থেকে প্রতিদিন উত্তোলন করা হচ্ছে ৪ লাখ লিটার দুধ। যশোরের জনসংখ্যা ২৭ লাখ ৬৪ হাজার হিসেবে স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী মাথা প্রতি ১২০ মিলি লিটার দুধ গ্রহণ করলে শুধু পান করা দুধের চাহিদা দাঁড়াবে প্রতিদিন সাড়ে ৩ লাখ লিটার। মানুষ দুধ না খেয়ে কমল পানীয়তে বেশি আগ্রহী হওয়ায় বিকল্প ব্যবস্থায় দুধ প্রক্রিয়াজাত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সমন্বিত উদ্যোগে যশোরে দুধ প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণের জন্য মিল্ক প্রসেসিং প্লান্ট স্থাপনের দাবি উঠেছে। সমবায় অধিদপ্তরের মাধ্যমে যশোর ডেইরী এন্ড ফ্যাটেনিং দুগ্ধ সমবায় সমিতি বিক্রির বাজার বাড়ানোসহ দুধ সংরক্ষণে প্রসেসিং প্লান্ট স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তর ও খামারী সূত্র জানিয়েছে, জেলায় ছোট বড় মিলিয়ে ৩ হাজার ৩২টি ডেইরী খামার রয়েছে। সর্বনিম্ন ৩টি গাভী নিয়ে গড়া খামার হিসেবে যশোর সদর উপজেলায় রয়েছে ৬৭০টি খামার। এরমধ্যে সদর উপজেলায় ডেইরী এন্ড ফ্যাটেনিং দুগ্ধ সমবায় সমিতির ব্যানারে রয়েছে ৪০টি বড় ডেইরী খামার।
প্রাণি সম্পদ দপ্তরের হিসেব মতে খামারের বিপরীতে যশোর জেলায় প্রতিদিন দুধ উৎপাদন হচ্ছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার লিটার। এই বিশাল উৎপাদনের বিপরীতে বিক্রি বাজার সংকীর্ণ বলে দাবি খামারীদের। সংরক্ষণ কিংবা প্রক্রিয়াজাত করার সুযোগ যশোরে না থাকায় তারা ৪৫ থেকে ৫৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
দোকানে খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা কেজি। আবার বাজার না থাকায় জেলায় প্রায় ৫০ হাজার লিটার দুধ প্রতিদিন গাভীর বানে রেখে দেয়া হচ্ছে বলেও দাবি তাদের। এর মধ্যে যশোর সদর উপজেলার প্রায় ১২ হাজার লিটার ও সমবায়ভুক্ত ৪০টি ডেইরী খামারে দুধ বানে থেকে যাচ্ছে এক হাজার লিটার প্রতিদিন।
তাদের দাবি, যশোরের ছোট ছোট ও বড় খামারীদের চলমান লোকসান কাটাতে দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণে বিশাল কর্মপরিকল্পনা জরুরি। ডেইরী রেভুলেশন প্রকল্প হাতে নেয়া যেতে পারে। খামারীদের আয় বৃদ্ধি, দুধের উৎপাদন ও সংরক্ষণ এবং মূল্য সংযোজন পন্য উৎপাদনেও কাজ করা যেতে পারে। জেলা শহরের সুবিধাজনক জায়গায় দুধ প্রসেসিং প্লান্ট স্থাপনসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে সমবায় ভিত্তিক সিলিং প্লান্ট বসানোর পরিকল্পনার আওতায় আনার দাবি তুলেছেন খামারীরা।
এ ব্যাপারে যশোর সদর উপজেলার ডেইরী খামারীদের নেতৃত্বদানকারী প্রতিষ্ঠান ডেইরী এন্ড ফ্যাটেনিং দুগ্ধ সমবায় সমিতি যশোরের সভাপতি মফিজুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন জানিয়েছেন, তাদের জানা তথ্য মতে এই মুহূর্তে সমিতিভুক্ত ৪০টিসহ সদর উপজেলায় ২শ’টি খামারের নাজুক অবস্থা। এছাড়া গোটা জেলার চিত্র একই।
পশুখাদ্যের দাম বৃদ্ধি, শ্রমিক মূল্য দিয়ে বাজারজাত খরচ, সব মিলিয়ে দুধ বিক্রিতে লোকসান হচ্ছে। এছাড়া উৎপাদিত সব দুধ বিক্রিও হচ্ছে না করোনা সংকটের কারণে। আর যশোরে সংরক্ষণ কিংবা প্রক্রিয়াজাত করার ব্যবস্থা না থাকায় দুধ বানে রেখে দেয়া হচ্ছে। বিশাল পরিমাণের দুধ বিকল্প ব্যবহারের উপায় খুঁজে মানুষকে খাওয়ানো গেলে ঘুরে দাঁড়াবে যশোরের ডেইরী খামার সেক্টর।
তারা দাবি করেছেন, প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তর কিংবা সমবায় অধিদপ্তর একটু আন্তরিক হলে দ্রুতই যশোরের খামারিদের ভাগ্য উন্নয়ণে কাজ করতে পারে। দুধ উৎপাদনের বিপরীতে সংরক্ষণ এবং মূল্য সংযোজন পন্য উৎপাদনও করা যেতে পারে। বিশেষ করে গুড়ো দুধ তৈরি করা যেতে পারে। কোমল পানীয়তে পাবলিকের আকর্ষণ বেশি। সে দিকটা মাথায় রেখে পানীয়ের মধ্যে দুধ ব্যবহার করে দুধের বিকল্প ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে।
এছাড়া দুগ্ধ ব্যবহার বাড়িয়ে সংরক্ষণ করা যেতে পারে এমন উপায়ে দই, মিষ্টি, এমনকি দানাদার তৈরি খারখানাও করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে দ্রুত যশোরে মিল্ক প্রসেসিং প্লান্ট স্থাপন দাবি তাদের।
যশোরে প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা গেলে এগিয়ে যাবে খামারগুলো। একইসাথে দুধের চাহিদা পূরণ করেও অন্য জেলায় সরবরাহ কর যাবে। এ ব্যাপারে সমবায় সমিতির মাধ্যমে তারা উদ্যোগ নিচ্ছেন। প্রয়োজনীয় সরকারি ঋণ সুবিধা পাওয়া গেলে যশোরে করা যেতে পারে প্রসেসিং কেন্দ্র।
এ ব্যাপারে যশোর সদর উপেজলা সমবায় অফিসার রনজিত কুমার দাশ জানিয়েছেন, দ্রুতই সমন্বিত সমবায় ভিত্তিক মিল্ক প্রসেসিং প্লাট করার দিকে এগুনো হচ্ছে। যশোরে একটি সুবিধাজনক জায়গায় জমি খোঁজা হচ্ছে। প্রস্তাবনা আকারে মোটা অংকের ঋনের জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হবে।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে সমবায় ভিত্তিক সিলিং প্লান্ট বসানোও হতে পারে। সব মিলিয়ে নিরাপদ দুধ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে যশোরে একটি বিপ্লব ঘটানো সম্ভব হবে। সংরক্ষণ, এমনকি মূল্য সংযোজন পন্য উৎপাদনে মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করা হবে।
জেলা শহর, উপজেলা শহর, বড় বাজার, ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড পর্যায়ে উদ্যোক্তা খামারিদের সাথে নিয়ে এই কাজ এগুচ্ছে। প্রসেসিং কেন্দ্র তৈরি সম্ভব হলে পরিবেশ বান্ধব ডেইরী খামার ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠবে।