প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর, ২০২০ ০৬:৩৫ পূর্বাহ্ন
যশোর থেকে খান সাহেব : '‘যশোরের যশ খেজুরের রস’' শুধু কথায় নয়, কাজেও। শীতের আমেজ শুরু হয়েছে। তাই প্রতি বছরের মত যশোরের চৌগাছা অঞ্চলের গাছিরা খেজুরের রস আহরণের জন্য তোড়জোড় শুরু করেছেন। গাছিরা খেজুর গাছ থেকে রস বের করার জন্য শুরু করেছেন প্রাথমিক পরিচর্যা। স্থানীয় ভাষায় এটাকে গাছ তোলা বলে। এক সপ্তাহ পরই আবার চাঁছ দিয়ে নলি, গুজা লাগানো হবে।
খেজুর গাছ থেকে রস বের করতে তিন স্তর পেরিয়ে তারপরেই রস আহরণ শুরু হয়। গ্রাম বাংলায় এখন চোখে পড়ছে খেজুর গাছ তোলা চাঁছার দৃশ্য। গাছিরা এখন মাঠে মাঠে মহা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। কিছুদিন পরই গৌরব আর ঐতিহ্যের প্রতীক মধু বৃক্ষ থেকে সুমধুর রস বের করে গ্রামের ঘরে ঘরে শুরু হবে নতুন গুড়, পাটালি তৈরির উৎসব।
গ্রামে গ্রামে খেজুরের রস জ্বালিয়ে পিঠা, পায়েস, মুড়ি মুড়কি ও নানা রকমের মুখরোচক খাবার তৈরির ধুম পড়বে। রসে ভেজা কাচি পোড়া পিঠার (চিতই পিঠা) স্বাদই আলাদা। নলেন গুড়, ঝোলা গুড় ও দানা গুড়ের সুমিষ্ট গন্ধেই যেন অর্ধ ভোজন। রসনা তৃপ্তিতে এর জুড়ি নেই। নলেন গুড় পাটালির মধ্যে নারিকেল কোরা, তিল ভাজা মিশালে আরও সুস্বাদু লাগে।
যশোরের ঐতিহ্যবাহী গুড়-পাটালির ইতিহাস অনেক প্রাচীন। এখানকার বিখ্যাত এ গুড়-পাটালি ভারত, পাকিস্তান, আমেরিকা, মালেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে যায়। ব্রিটিশ শাসনামলে খেজুর রস থেকে চিনি তৈরি করার জন্য যশোরের চৌগাছায় চিনি ফ্যাক্টরি স্থাপিত হয়। যেখানে তৈরি হত উন্নতমানের চিনি। খেজুুুুরের গুড় থেকে ‘ব্রাউন সুগার’ উৎপাদনেরও সুনাম রয়েছে। তৈরি করা হতো রস দিয়ে উন্নতমানের মদ।
খেজুর গাছ আন্যন্য গাছের মত বপন করা বা সার মাটি দিতে হয় না। প্রাকৃতিক নিয়মেই মাঠে পড়ে থাকা খেজুরের আঁটি (বিচি) থেকে চারা জন্মায়। সৃষ্টি হয় খেজুরের বাগান। তবে খেজুর গাছ ইট ভাটার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় বেশ আগে থেকেই এ অঞ্চলে গুড়, পাটালির উৎপাদন বহুলাংশে কমে গেছে। এখন আর আগের মত মাঠ ভরা খেজুর বাগানও নেই, নেই মাঠে মাঠে রস জ্বালানো বান (চুলো)। যা আছে তা নিতান্তই কম। নলেন গুড়, পাটালি পাওয়া দুষ্কর। এ মৌসুমে যা তৈরি হয় তা রীতিমত কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে যায়।
আবহমান কাল থেকে তাই বাংলায় নবান্নের উৎসব পালনে খেজুর গুড়ের কদর বেশি। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে গাছিরা গাছ পরিষ্কার বা তোলা চাঁছা করার জন্য গাছি দা, দড়ি তৈরিসহ ভাঁড় (মাটির ঠিলে) কেনা ও রস জ্বালানো জায়গা ঠিক করাসহ বিভিন্ন কাজে রয়েছেন ব্যতিব্যস্ত। তবে সংশ্লিষ্টরা জানান গাছ কাটা, রস জ্বালানো ও গুড়-পাটালি তৈরির উপকরণের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় এবার অন্যান্য বছরগুলোর তুলনায় গুড়-পাটালির দাম বেশি হবে।
এদিকে যশোর অঞ্চলে খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারের বনবিভাগের উদ্যোগে গত কয়েক বছর আগে খেজুর গাছ রোপণের কাজ শুরু হয়েছে। ‘বৃহত্তর যশোর জেলার জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ উন্নয়ন’ প্রকল্পের আওতায় এ অঞ্চলে রোপিত হয়েছে খেজুর গাছের সাড়ে তিন লাখ চারা। দেশি জাতের সাথে পরীামূলকভাবে আরব দেশিয় খেজুরের চারাও রোপণ করা হয়েছে বলে বনবিভাগ জানিয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিংহঝুলি ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মেহেরুন্নেছা রিমা বলেন যশোর অঞ্চলে খেজুর গাছের সংখ্যা বাড়াতে সরকারী প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা রাস্তার পাশে জমির আইলে ও পতিত জমিতে খেজুর গাছ রোপনের জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকি।
চৌগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রইচ উদ্দীন জানান, খেজুর গাছ রোপণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমরা ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছি। আমাদের কর্মসূচি সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে যশোরের খেজুুর গুড়ের ঐতিহ্য আবার ফিরে আসবে এবং সাথে সাথে এ অঞ্চল অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধশালি হবে। তিনি আরো বলেন আমাদের অফিসের পুরা টিম সরকারের কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছে।