ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ ভাদ্র ১৪৩১, ৯ শাওয়াল ১৪৪৫

শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড, বাংলাদেশের জাতির পিতা


প্রকাশ: ১৪ অগাস্ট, ২০২০ ১৪:০০ অপরাহ্ন


শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড, বাংলাদেশের জাতির পিতা

   

হাফিজুর রহমান : ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ড নিয়ে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র রিসার্চ করতে যেয়ে ৩ টা পয়েন্ট গুরুত্বপূর্ণ অনুধাবন হয়েছে তা হল-

কেনো? 
কীভাবে?  
কারা? 
সরাসরি আলোচ্য অংশের সত্যতা যাচাই করার জন্য প্রথমেই কেন হত্যা করা হয়েছিল সে প্রশ্নের উত্তর খুজতে হবে যার জন্য বিশ্বের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটের আলোকে বিশ্লেষণ করতে হবে। 

কেনো? 
২য় বিশ্ব যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে বিশ্বের সামগ্রিক সম্পদ ও ক্ষমতা নিজেদের হাতে নেওয়ার জন্য বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে একটা নতুন আইডিয়া আমেরিকার মাথায় আসে তাহলো গ্লোবাল এম্পায়ার ক্রিয়েট করা। আর এই এম্পায়ার ক্রিয়েট করার নিমিত্তে কোনো প্রকার মিলিটারি ঝামেলা নয় বরং এক অর্থনৈতিক পলিসি থাকবে। যেটাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হবে। যেখানে টার্গেট করা হয় থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রি কভারড উইথ রিসোর্সেস লাইক তেল,গ্যাস।  

এটা এমন এক ব্যবস্থা যেখানে কোনো প্রকারের ঝামেলা ছাড়াই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৩য় বিশ্বের কোনো এক রাষ্ট্রকে টার্গেট করে,কভার্ড সম্পদে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখার নিমিত্তে নানান রকমের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করে যেটাকে ডিপ্লোমেটিক পদ্ধতিতে ইকনমিক হিটম্যান বলা হয়। 

এই পদ্ধতিতে তারা প্রথমে টার্গেটেড দেশের প্রধানকে করাপ্টেড করার চেষ্টা করবে। করাপ্টেড হলে প্রুফ রেখে নিজেদের ইচ্ছেমতো উক্ত রাষ্ট্র থেকে কভার্ড সম্পদ আরোহন করবে কেননা এত পরিমাণ সম্পদ দিয়ে করাপ্টেড করা হয় যে তা ব্যাক করার মত সম্পদ ও সুযোগ কোনোটাই রাষ্ট্র প্রধান পায়না।এটা অনেকটা সমস্যা তৈরী করে ফাদে ফালানোর জন্য নিজেদের মত করে সমাধানের পথ দেখানো যে পথ দিয়ে রাষ্ট্র
প্রধান যেতে বাধ্য। ফলে তাদের বলা হয় যেহেতু তুমি ঋন পরিশোত করতে পারছনা সেহেতু তোমার তেল অথবা গ্যাস দাও আমাকে। 

রাষ্ট্র প্রধানের ধাপ সফল না হলে পরবর্তী ধাপ হলো  রাষ্ট্র কে লোন এনে দেওয়া উন্নয়ন এর নাম করে এবং ঋনের ফাদে ফেলানো । এখানে রাষ্ট্রকে লোন ইকনমিক হিটম্যান রাই এনে দিবে বিশ্বব্যাংক কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের  সাহায্যকারী সংস্থা থেকে এবং টাকা তাদের মাধ্যমেই দেশের অভ্যন্তরীণ ইনফ্রাস্ট্রাকচার বাস্তবায়নে খরচ হবে।বেনিফিটেট হয় হাতে গোনা কিছু মানুষ কিন্তু বোঝা বইতে হয় সমগ্র রাষ্ট্র কে। 

ইকনোমিক হিটম্যানদের পলিসি রাষ্ট্র প্রধান এবং রাষ্ট্রের  বিরুদ্ধে ফেইল করলে ২য় অবস্থায় আসে দেশের অভ্যন্তরীণ জ্যাকলসরা যারা সরকার পতন কিংবা এসাসিনেশন পর্যন্ত করে ফেলে। আর এটাও ফেল করলে আমেরিকা অজুহাত দিয়ে মিলিটারি পাঠায় যেমনটা ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে করা হয়েছিল এবং ঘানার নেতা বুট্রুস লুমুম্বার বিরুদ্ধেও। যেখানে আমেরিকার কথা না শোনার জন্য তেল সমৃদ্ধ ঘানা ও ইরাকের রাষ্ট্র প্রধান দের হত্য করা হয়েছিল। পানামা ও ইকুয়েডরের রাষ্ট্রপ্রধানদের হিটম্যান কাবু করতে না পারায়  দেশের জ্যাকলসরা পরবর্তীতে দুজনকেই বিমান দূর্ঘটনায় হত্যা করে।  

শুধুমাত্র ইকনমিক হিটম্যান দের প্রস্তাবে রাজি না হওয়া এবং দেশের স্বার্থ বিলিয়ে না দেওয়ার ঘোষণা দিলে হত্যা করা হয় চিলির লিবারেল ডেমক্রেসির প্রথম নির্বাচিত  প্রেসিডেন্ট সালভাদরকে। হত্যা করা হয় গুয়েতেমালার ২য় নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জ্যাকবো আর্বিনেজকে,হত্যা করা হয় ইরানের প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেককে। 

৭১ এ যুদ্ধের পরবর্তীতে সমগ্র বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে কন্ঠস্বরের মাধ্যমে জাতিসংঘ সহ বিভিন্ন প্রোগ্রামে নিজের অবস্থান পরিস্কার করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সাম্রাজ্যবাদীতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বিশ্বের অসহায় ও অভাবগ্রস্থ মানুষের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ভাল চোখে দেখেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ করে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার।  

কিসিঞ্জার, যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন ও জেরাল্ড ফোর্ড  সরকারের  সময় প্রতিরক্ষামন্ত্রী পাশাপাশি জাতীয় নিরাপত্তা পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে।হেনরি কিসিঞ্জার ৭১ এ যুদ্ধকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধু ও তার স্বপনের বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ছিল। ৭১ এ যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের পরাজয় সহজে মেনে নিতে পারেনি।কিসিঞ্জার এই পরাজয় কে নিজের পরাজয় ও যুক্তরাষ্ট্রের ডিপ্লোম্যাসির এক বড় লস হিসেবে নেয়। আর তখনই শুরু হয় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার এক পলিসি।  বঙ্গবন্ধুকে যখন হিটম্যান কাবু করতে পারেনি তখনই দেশের অভ্যন্তরীণ জ্যাকলসরা দেশের সার্বিক অবস্থা চরমে তুলে দেয়,সমস্যা কিংবা রিপোর্ট চক্রান্ত অনুযায়ী বানিয়ে দেশকে অশান্ত করে তুলে যার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু বলেছিল যে"পাকিস্তানি হানাদার রা সব সম্পদ নিয়ে গেছে আর রেখে গেছে কিছু চোরের দল"। দেশের যাই উন্নতি হচ্ছিল তার সুবিধা ভোগ করছিল ৫% মানুষ।

পাশাপাশি পাকিস্তানিদের ক্ষোভ ছিল যে একমাত্র শেখ মুজিবের জন্যই পাকিস্তান পরাজয় বরন করেছে। ফলে প্রেক্ষাপটে চলে আসে পাকিস্তানের  আইএসআই! 

কীভাবে?  
ইকনমিক হিটম্যান পলিসি বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে  ব্যার্থ হয়।উল্টো  ৭৫ সালের জুন মাস নাগাদ দেশের অর্থনীতি বেশ ভাল যায়গাতে চলে আসে তখনই প্রেক্ষাপটে চলে আসে দেশের অভ্যন্তরীণ জ্যাকলসরা। এরা প্রথমে সরকার পতনের জন্য চেষ্টা চালায় কিন্তু শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তার কাছে তাদের ষড়যন্ত্র কিছুই ছিলনা। তাই ডিরেক্ট হত্যা করার মিশনে নেমে যায় তারা। জ্যাকলসরা দেশের পেপার পত্রিকা কিংবা পরিসংখ্যান এ মনগড়া কথাবার্তা লিখে মানুষকে ভুল বুঝিয়েছিল। গুজব ছিল তাদের শক্ত হাতিয়ার।  

বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে শেখ কামাল,শেখ জামাল ও ভগ্নিপতি শেখ মনিকে নিয়ে ভূয়া তথ্য ও গুজব ছড়াচ্ছিল অর্থাৎ শেখ মুজিবের পরিবারের প্রতি ক্ষোপ ছড়াচ্ছিল উদ্দেশ্য  জুনিয়র আর্মি অফিসাররা যাদের মধ্যে জ্যাকলসরা তাদের উদ্দেশ্য সফল করতে পেরেছিল। 

কারা? 
মুজিবনগর সরকার গঠন থেকে যুদ্ধকালীন সময়ে খন্দকার মোশতাক আহমেদ এর ভুমিকা ছিল বিতর্কিত। সে চেয়েছিল ৭১ এ জাতিসংঘে যেয়ে পাকিস্তানের পক্ষে নিতে কিন্তু তাজউদ্দীন আহমেদ এর বিচক্ষণতায় তা পারেনি। যার দরুন হত্যা পরবর্তী সময় স্বাভাবিক ভাবে পার করতে মোস্তাক আহমেদ ছিল বেটার অপশন। তাই তাকেই রাষ্ট্রপতি বানানো হয়। 

৭৩ সালে হঠাৎ ডেপুটি চিফ অফ আর্মি মেজর জিয়া ৩ সপ্তাহের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যায় এবং সেখানে পাকিস্তানি এম্বাসিতে সে সাক্ষাতে যেখানে তার কোর্সমেটদের পায়। মেজর জিয়ার এই সাক্ষাৎ আন্দাজ করতে পেরে পরবর্তীতে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য ক্যু এর কথা জেনেও শেখ মুজিবুর রহমান তা পাত্তা দেন নি। 

৩০ শে অক্টোবর, ৭৪সালে কিসিঞ্জার বাংলাদেশে আসে এবং বাংলাদেশে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের সাথে মিটিং করে।বঙ্গবন্ধুর সাথেও তার সাক্ষাৎ হয়। মূলত এই শর্ট সফরের পরেই ইউএস এম্বেসির সাথে আর্মির কর্মকর্তা দের বেশ আলোচনা শুরু হয়। এই সফরের মাধ্যমে কিসিঞ্জার এদেশীয় জ্যাকলসদের শক্তিশালী করে দিয়ে যায়। তাদের নানান রকমের গোপনীয় কার্যক্রম চলতে থাকে। তারা ঢাকাতে সি আই এর প্রধান, ফিলিপ চেরির সাথে যোগাযোগ করতে থাকে।

সেনাপ্রধান না হতে পেরে ১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন ডেপুটি চিফ অফ আর্মি জিয়াউর রহমানের রিটায়ার্ড এ যাওয়ার কথা ছিল অথচ যখন ১৫ ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা করা হয় তখন জিয়াউর রহমানের বক্তব্য ছিল"so what if the president is killed vice president is there ".বাকশালের সদস্য হওয়ার জন্য তৎবির করা এই ডেপুটি চিফ অফ আর্মি যেখনে  অভ্যুত্থান কারী দের বিপক্ষে পাল্টা এটাকে যাবে তা না করে সে মাত্র ১০ দিন পরেই সেনাপ্রধান হন। বঙ্গবন্ধু যাকে আর্মি চীফ বানাতে চাননি সেই তার মৃত্যুর মাত্র ১০ দিন পর আর্মির চিফ হয়ে যায়! 

৭৫ পরবর্তীতে মেজর জিয়া ১৫ আগস্টের হত্যার সাথে জড়িত এমন ১২ জনকে তার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ দিয়ে পুরস্কৃত করে এমনকি জয় বাংলা স্লোগানকে বাদ দিয়ে "বাংলাদেশ জিন্দাবাদ" স্লোগান চালু করে! 

বঙ্গবন্ধু হত্যার মাত্র ৩ সপ্তাহের মধ্যে ৬ই সেপ্টেম্বর জুলফিকার আলীর বিশেষ দূত মাহমুদ আলী, পাকিস্তান থেকে লন্ডনে যেয়ে৭১ এ ষড়যন্ত্রকারী খন্দকার মোস্তাকের সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করে পুনরায় বাংলাদেশকে পাকিস্তানের সাথে এক করতে।কনফেডারেশন করে একই পতাকার তলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে নিয়ে আসতে! টানা ৩ সপ্তাহ চেষ্টা করতে থাকে যে কখন খন্দকার মোশতাক সে ঘোষণা দিবে! 

অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরিকল্পনা দুই বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানি এম্বাসিতে বসেই ঠিক হয়েছিল।১৯৭৫ থেকে ৮১ সাল পর্যন্ত যত সামরিক ক্যু এর চেষ্টা কিংবা ক্যু হয়েছে তার নেতৃত্ব যারা দিয়েছে তারা সকলেই পাকিস্থান থেকে এসে মুক্তিযুদ্ধ অংশগ্রহণ করে।ফলে আইএসআই কে ব্যবহার করে  কিসিঞ্জার এর পক্ষে দেশের অভ্যন্তরীণ জ্যাকলস হিসেবে সেনা অফিসার দের ব্যবহার করা সহজতর ছিল। 

যে লোকের উচ্চাভিলাষীতার জন্য বঙ্গবন্ধু তাকে সেনা প্রধান বানাতে চাননি,তিনিই বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর মাত্র ১০ দিন পর সেনাপ্রধান হন এটা কোনো কো ইন্সিডেন্ট না বরং দীর্ঘ সময়ের এক পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।  

রেফারেন্সঃ 
*inside raw the story of India’s secret service.  
*বাংলাদেশ রক্তাক্ত অধ্যায়(১৯৭৫-৮১),ব্রিগেডিয়ার শাখাওয়াত হোসেন।  
*শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল,মওদুদ আহমেদ 
*বিএনপির সময় অসময়, মহিউদ্দিন আহমেদ  
*tha trial of henry kissinger, chistopher hitches. 
*তাজউদ্দীন আহমেদ, নেতা ও পিতা।শারমিন আহমেদ।  
*বাংলাদেশের রক্তের ঋন, এন্থনি মাস্কারেনহাস।

হাফিজুর রহমান 
আইন বিভাগ  
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


   আরও সংবাদ