ঢাকা, বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২ বৈশাখ ১৪৩২, ২৬ জ্বমাদিউল সানি ১৪৪৭

"জসীমউদ্দিনের স্মৃতিপটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রনাথ ও স্যার এ. এফ. রহমান"


প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর, ২০২০ ১৬:১৭ অপরাহ্ন



ঢাবি থেকে তরিকুল ইসলাম : গল্পে যাওয়ার পূর্বে গুণীজন, "স্যার এ এফ রহমান" ( আহমেদ ফজলুর রহমান) সম্পর্কে একটু আলোকপাত করা যেতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বাঙালী উপাচার্য হিসেবে আমরা সকলেই স্যার এ. এফ. রহমান এর নাম জেনে থাকবো। ১৮৮৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি তে জন্ম নেয়া আহমেদ ফজলুর রহমান অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন যার আদি পিতৃ-ভিটা ফেনী জেলায়।


ইতিহাসবিদ, সমাজ সংস্কারক ও সফল শিক্ষাবিদ হিসেবে তিনি তাঁর গোটা জীবনে মেধার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। ১৯০৮ জলপাইগুড়ি থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রবেশিকা পাশ করে, ১৯১২ সালে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ.(সম্মান) ইতিহাসে ডিগ্রী প্রাপ্ত হন। এরপর পলিটিক্যাল ইকোনমি'র উপরে

লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সে গবেষণা করেন তিনি।

দেশে ফিরে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগদান করলেও, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের একজন সদস্য হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন স্যার এ.এফ.রহমান। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর পি.জে.হার্টগ এর অনুরোধে স্যার এ.এফ.রহমান ইতিহাস বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন মুসলিম হলের (সলিমুল্লাহ মুসলিম হল) প্রথম প্রভোস্ট হিসেবে যোগদান করেন। এফ রহমানের দক্ষতা ও সক্ষমতায় ১৯৩৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর পদে নিযুক্ত হন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার এক দশক পরে, কবি ও গান সংগ্রাহক হিসেবে পল্লীকবি জসীমউদ্দীন বেশ খ্যাতি লাভ করলেও এম.এ পাশ করিয়া বেকার অবস্থায় উদ্ভ্রান্তের মতো হন্যে হয়ে চাকুরি খুঁজতেছিলেন। সেই সময়ে কলকাতার ঠাকুর বাড়িতে বা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল জসীমউদ্দীনের।

সাম্প্রদায়িক তালমাতাল অবস্থায় দেশের সর্বত্র বিষ ছড়িয়ে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কে বেশ বৈরীতা যাচ্ছিল, যার প্রভাব চাকরির বাজারেও বিরাজমান ছিল। তখনকার দিনে রবীন্দ্রনাথের বেশ প্রভাব বলয় তৈরী হয়েছিল, তাঁর পত্র বা সুপারিশেই জসীমউদ্দীন প্রথম কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে "উপ গবেষক" হিসেবে কাজ পেয়েছিলেন। সাম্প্রদায়িক ওই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও রবীন্দ্রনাথের উপর এ বিষয় এতটুকু প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি যার সত্যতা মিলে জসীমউদ্দীনের বয়ানে _

"যখনই যেজন্য তাঁর কাছে গিয়াছি,তিনি হাসিমুখে তাহা করিয়া দিয়াছেন।মুসলিম বলিয়া তিনি আমাকে দূরে সরাইয়া রাখেন নাই।"

আরেকটি ঘটনায় আরোও বেশি স্পষ্টভাবে এ বিষয়ে  দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। "স্যার এফ, রহমান তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর। তিনি আমাকে বলিলেন, রবীন্দ্রনাথ অথবা অন্য নাম-করা লোকের কাছ থেকে যদি কোন ব্যক্তিগত পত্র আনতে পার,তবে এখানে বাংলা-বিভাগে তোমার জন্য কাজের চেষ্টা করতে পারি।"

তথ্যসূত্র_ ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়, জসীমউদ্দীন তাৎক্ষনিক কলকাতায় গিয়া জসীমউদ্দীন বাংলা সাহিত্যের দুইজন দিকপালের সাথে দেখা করলেও, সাম্প্রদায়িকতার দিন বলে মুসলিম হওয়াও জসীমউদ্দীন কে তাঁরা আশাহত করে। অথচ হিন্দু প্রার্থীকে না চিনলেও সুপারিশ করছে। স্রোতে পড়া লোকের মতো তৃণের আশায় শেষমেশ শান্তিনিকেতনে গিয়ে হাজির হন জসীমউদ্দীন।

"সকালবেলা। কবি বারান্দায় বসিয়াছিলেন।পূর্ব গগনে রঙিলা ভোর মেঘে মেঘে তাঁর নক্সার কাজ তখনও বুনট করিয়া চলিছে। সামনের বাগানে পাখির গানে ফুলের রঙে আর সুবাসে আড়াআড়ি চলিয়াছে।সালাম জানাইয়া কবির সামনে গিয়া দাঁড়াইলাম। কুশলপ্রশ্নের উওর দিয়া কবিকে আমার আগমনের কথা বলিলাম।কবি তৎক্ষণৎ তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারি অমীয় চক্রবর্তী মহাশয়কে আমার জন্য একখানা সুপারিশপত্র লিখিয়া  আনিতে নির্দেশ দিলেন। "

জসীমউদ্দীন তাঁর পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে লেকচারার হিসেবে কাজে নিযুক্ত হন। এসময় ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত আহমেদ ফজলুর রহমান ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে সাফল্যের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। স্যার এ.এফ. রহমানের অবদান ও অসামান্য কৃতিত্বের স্বীকৃতি-স্বরূপ ১৯৩৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনারারি ডক্টরেট ডিগ্রী ও ১৯৪২ সালে  ব্রিটিশ সরকার রাজকীয় খেতাম নাইটহুড সম্মাননা দেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে  বাংলাদেশ রাষ্ট্র জন্মলাভ করলে, স্যার আহমেদ ফজলুর রহমানের নামে_  ১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ. এফ. রহমান হল প্রতিষ্ঠা করা হয়।

স্যার এ. এফ. রহমানের ৭৫ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি রইলো শ্রদ্ধা।

স্যার এ. এফ. রহমান (২৮ ডিসেম্বর ১৮৮৯ - ১০ ডিসেম্বর ১৯৪৫)

 


   আরও সংবাদ