ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ ভাদ্র ১৪৩১, ১১ শাওয়াল ১৪৪৫

দেড় যুগ পরেও চিনাটোলা কলেজটি এমপিওভুক্ত হয়নি মানবেতর জীবন যাপন করছে শিক্ষকরা


প্রকাশ: ২০ অগাস্ট, ২০২০ ১৪:০০ অপরাহ্ন


দেড় যুগ পরেও চিনাটোলা কলেজটি এমপিওভুক্ত হয়নি মানবেতর জীবন যাপন করছে শিক্ষকরা

   

মণিরামপুর যশোর থেকে আব্বাস উদ্দীন : প্রতিষ্ঠার দেড় যুগ পরেও যশোরের মণিরামপুর উপজেলার চিনাটোলা কলেজটি এমপিওভুক্ত না হওয়ায় ৩০ জন শিক্ষক-কর্মচারি আর্থিক দৈন্যতায় পরিবার-পরিজন নিয়ে বর্তমানে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এমপিও (মানলি পেমেন্ট র্অডার) নামের সোনার হরিণ পাবার আশায় এই কলেজের শিক্ষক-কর্মচারি বিনা বেতনে চাকুরি করে চাকুরি জীবনের অর্ধেকেরও বেশী সময় ইতিমধ্যে পার করে ফেলেছেন। এ

ই কলেজ ছেড়ে তাদের বিকল্প অন্য কোন চাকুরিতে যাবার সুযোগও এখন নেই। জীবনে অনেক আশা-আকাঙ্খা নিয়ে লেখা-পড়া শেষ করে কলেজে চাকুরি করতে এসে বেকার জীবনের ন্যায় এক অনিশ্চিত অভিশপ্ত জীবনের ঘানি তাদের টানতে হচ্ছে। দীর্ঘ সময় পরে গত বছর সরকার অনেক প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করেছেন বটে কিন্তু চিনাটোলা কলেজটি এমপিওভুক্ত না হওয়ায় এই কলেজের সকল শিক্ষক-কর্মচারি এখন চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে পড়েছেন কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ সাজ্জাদ হোসেন। 

তা ছাড়া প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে যে সব শিক্ষক-কর্মচারী সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে এটির শিক্ষা কার্যক্রম পরিচলনা করে শিক্ষার মান যথাযথ বজায় রেখেছেন তারাও বর্তমানে উভয় সংকটে পড়েছেন। কলেজের প্রতি টানজাত মানসিকতা তাদেরকে এই পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। বিনা বেতনে দীর্ঘ চাকুরি জীবনে সংসারের ঘানি টানতে যেয়ে এবং পরিবার-পরিজনের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে ব্যর্থ এসব শিক্ষক-কর্মচারিরা তাদের নূন্যতম মর্যাদা নিয়ে জীবন-জীবিকা চালাতে না পেরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। 

শিক্ষক-কর্মচারীদের এহেন পরিস্থিতির মধ্যে কলেজের ভৌত-অবকাঠামোর হালচাল বর্তমানে চরম নাজুক অবস্থায় রয়েছে। সরেজমিন গত মঙ্গলবার (১৮ আগস্ট) যেয়ে দেখা যায়, ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত চিনাটোলা কলেজটিতে দুইটি আধা-পাকা টিনশেডের বিল্ডিং রয়েছে। যার অবস্থা খুবই জরাজীর্ন। সম্প্রতি আম্পান ঝড়ে দু’টি বিল্ডিংয়ের টিনের ছাউনি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঝড়ে কয়েকটি গাছ উপড়ে কলেজ বিল্ডংয়ের উপরে পড়ায় অনেক স্থানের টিনের চাল ভেঙে গেছে এবং টিন উঠে গেছে। একটু বৃষ্টি হলে ভবন দু’টির অধিকাংশ কক্ষে বৃষ্টির পানি পড়ছে। শ্রেণি কক্ষগুলোতে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের মত পরিবেশও নেই। প্রায় বছরই অতিবৃষ্টি ও বন্যায় কলেজটি পােিনত প্লাবিত হয়। কলেজের অধ্যক্ষ সাজ্জাদ হোসেন বলেন,প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এটির হাল ধরে আছি। আর পারছি না। 

সরকারি হিসেব মতে আমার আর ১০ বছর চাকুরি আছে। এমপিও’র আশায় জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ সময় এই কলেজে বিনা বেতনে চাকুরি করে পার করে দিয়েছি। আমি নিজেই এখন হতাশাগ্রস্ত। আমার সহকর্মীদের আর কোন আশা ভরসা দিয়ে এই কলেজে আকড়ে রাখবো সেই ভাষা আমার জানা নেই। 

স্থানীয়ভাবে ব্যক্তি মহলের সহযোগিতায় দুইটি টিনশেডের বিল্ডিং নির্মাণ করে এতোদিন শিক্ষা-কার্যক্রম চালাচ্ছিলাম। সেই ভবন দু’টিরও এখন ভগ্নদশা। একেতো কলেজে বেতন নেই তার উপর ভবন সংস্কার নিয়ে মহাচিন্তায় আছি।

তিনি জানান, দেড় যুগ আগে প্রতিষ্ঠিত এ কলেজটির উন্নয়নে এ যাবৎকালে মাত্র আড়াই লাখ টাকা সরকারিভাবে অনুদান পেয়েছি। আর কখনও কোন আর্থিক সহযোগিতা পাইনি। চলতি বছরের আমম্পান ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির পরে কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামনের মাধ্যমে কিছু সহযোগিতার জন্য আবেদন করেছি। কিন্তু এখন কোন সহায়তা পাইনি। দীর্ঘ চাকুরি জীবনে শিক্ষক-কর্মচারীরা সম্প্রতি সরকারের করোনা প্রণোদনা সহায়তার অংশ হিসেবে শিক্ষকরা ৫ হাজার টাকা হারে আর কর্মচারীরা আড়াই হাজার টাকা হারে অনুদান পেয়েছেন বলে তিনি জানান। 

কলেজ থেকে শিক্ষক-কর্মচারীদের কোন টাকা দেওয়া হয় কী না এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যক্ষ জানান, বিভিন্ন আভ্যন্তরিন পরীক্ষার সময় পরীক্ষার ফিসের টাকার থেকে যে টাকা সাশ্রয় হয় তা শিক্ষক-কর্মচারীদের মাঝে বন্টন করে দেওয়া হয়। তাতে বছরে সর্বসাকুল্যে জনপ্রতি দুই/আড়াই হাজার টাকার মতো হবে। তিনি আরও জানান, একাদশ-দ্বাদশ দুই শ্রেণি মিলে প্রতি শিক্ষাবর্ষে প্রায় ২৫০ জন নিয়মিত ছাত্র-ছাত্রী এই কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশুনা করে আসছে। 

এ যাবৎকালে সকল শিক্ষার্থীকে আমরা বিনা বেতনে পড়ালেখা করিয়ে আসছি। কলেজের অধিকাংশ শিক্ষক প্রাইভেট টিউশানি করে যা পাই তাই দিয়েই চলে আসছে। করোনাকালীন সময়ে প্রাইভেট টিউশানি বন্ধ থাকায় শিক্ষকরা এখন আরও বেকায়দায় পড়েছেন। 

অধ্যক্ষ সাজ্জাদ হোসেন আরও বলেন, গত ২০১৯ সালে এই কলেজ থেকে ১১৭ জন ছাত্র-ছাত্রী এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন।পরীক্ষার ফলাফলে ১জন জিপিএ-৫ সহ ৬৪ জন কৃতকার্য হয়েছে। কলেজটি পাশের হার ছাড়া সকল শর্ত পূরণ থাকা সত্বেও সর্বশেষ প্রদেয় এমপিওভুক্তির তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়নি।

কলেজটির একাডেমিক অবস্থা বর্ণনান্তে তিনি আরও জানান, ২০০৩-২০০৪ শিক্ষাবর্ষে এ কলেজে একাদশ শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। ২০০৫ সালে শিক্ষার্থীরা  প্রথম এইচএসসি(পাবলিক) পরীক্ষায় অংশ নেয়। সেই হতে ১৪/১৫ বছর ধরে প্রতি বছর গড়ে শতাধিক শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ৫০/৬০ শতাংশ পরীক্ষার্থী কৃতকার্য হয়ে কলেজ-বিশ^বিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া করে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে দেশের গুরুত্বপূর্ন পদে অনেকেই চাকুরি করছেন। 

চিনাটোলা কলেজের প্রভাষক মোঃ আব্দুল মোমিন খুব আক্ষেপ করে বলেন, আমাদের কপাল মন্দ,তাই দীর্ঘ সময়ে শ্রম দিয়েও আমরা সরকারি বেতনের জন্য এমপিওভূক্ত হতে পারেনি। একই সাথে বালিয়াডাঙ্গা খানপুর কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়ে তারা প্রায় ১৫ বছর ধরে এমপিও’র সুযোগ পাচ্ছে। তিনি বলেন, এমপিও তো পেলাম না, যদি একটা ভাল বিল্ডিংও পেতাম তাহলেও মনকে একটু সান্তনা দিতে পারতাম। 

বিনা বেতনে ১৭ বছর পার করেছি। বাকি জীবন হয়তো এভাবেই কাটাতে হবে। সংসারে স্ত্রী-ছেলে-মেয়েদের নিয়ে অভাব-অনাটনে আর কতকাল এভাবে চলা যায়! ভেবে কোন কুল-কিনারা খুঁজে পাইনে। প্রভাষক রবিউল ইসলাম বলেন, আমাদের আর কোথাও যাবার মত জায়গা নেই। তাই এখানে বাকী জীবন হয়তো এভাবে কাটাতে হবে। আমাদের কাছে পড়া-শুনা করে অনেকেই উচ্চ শিক্ষা নিয়ে ভাল ভাল সরকারি চাকুরি করছে।

আর আমাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন নেই। ওই সব কৃতি শিক্ষার্থীদের সামনে আমাদের মাথা ছোট হয়ে যায়। চিনাটোলা বজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও শিক্ষানুরাগী স্বপন কুমার কুন্ডু বলেন, দীর্ঘ দিন ধরে চিনাটোলা কলেজের ৩০ জন শিক্ষক-কর্মচারী বিনাবেতনে চাকুরি করে মানবেতর জীবন যাপন করছে। 

সরকার তাদের প্রতি সদয় হয়ে এমপিও ভুক্ত করে নিলে তাদের ভোগন্তির অবসান হতো। তিনি কলেজটি এমপিওভুক্তির জন্য সরকারের কাছে জোরালো দাবি জানান। এ ধরনের দাবি জানিয়েছেন কলেজ সংশ্লিষ্ট অভিভাবক, শিক্ষার্থী ও এলাকার বিশিষ্ট জনেরা।


   আরও সংবাদ