ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ ভাদ্র ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

নারী উদ্যোক্তা ও দেশীয় পণ্যের সমৃদ্ধি


প্রকাশ: ২২ জুন, ২০২০ ১৪:০০ অপরাহ্ন


নারী উদ্যোক্তা ও দেশীয় পণ্যের সমৃদ্ধি

   

অদিতি রিতু : একবিংশ শতাব্দীর নানবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এবং বিভিন্ন অর্থনীতিক ও সামাজিক বাঁধা পেরিয়ে নারীগণ সমাজে মর্যাদার স্থানে প্রতিষ্ঠিত হতে সর্বদা সচেষ্ট। তবে এ জন্য নারীদের স্বাবলম্বী হতে হবে, হতে হবে আত্মনির্ভরশীল। আর স্বাবলম্বী হওয়ার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে নিজেকে উদ্দ্যোক্তা হিসাবে গড়ে তোলা। বর্তমান বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় নারীদের অবদান অনস্বীকার্য। দেশের অনেক নারী আজ তাঁদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও সৃষ্টিশীল কর্মের সর্বোত্তম প্রয়োগের মাধ্যমে নিজেদের সফল নারী উদ্দ্যোক্তা হিসাবে গড়ে তুলেছেন।

বর্তমান বিশ্ব ও মানব সম্প্রদায় আজ এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পতিত। কোভিড-১৯ (করোনা ভাইরাস সৃষ্ট) নামক রোগের কারনে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যহত হচ্ছে এবং কর্মযজ্ঞে স্থবিরতা বিরাজ করছে। অদ্যাবধি এই রোগের কোন ওষুধ বা টিকা আবিস্কার না হওয়ায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং ঘরাবদ্ধ (লকডাউন) থাকাই নিজেকে রক্ষার অন্যতম উপায়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি এই লকডাউন মানুষের বিশেষ করে নারী, শিশু এবং বয়স্কদের নানাবিধ মানসিক সমস্যা তৈরির আশঙ্কা সৃষ্টি করছে। 

পাশাপাশি কর্মহীনতার জন্য পরিবারের আর্থিক উপার্জন কমে যাচ্ছে। তাই বিদ্যমান পরিস্থিতির সাথে আমাদের খাপ খাওয়াতে হবে, করোনার তৈরী হুমকী থেকে কর্মের নতুন সুযোগ খুজতে হবে। লকডাউনের সময়টাকে কাজে লাগিয়ে ঘরে ঘরে উদ্দ্যোক্তা তৈরী করতে হবে, আর এক্ষেত্রে নারীদের এগিয়ে আসতে হবে। তাঁরা নিজেদের শিক্ষা, প্রতিভা ও মননশীলতাকে কাজে লাগিয়ে একেকজন নারী উদ্দ্যোক্তা হিসাবে গড়ে উঠতে পারেন।

আশার কথা হলো এখন অনেক নারীই নিজে কিছু করার প্রেরণা থেকে কখনো এককভাবে, কখনো দলবদ্ধ হয়ে ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্য নিয়ে অনলাইন ব্যবসা করছে যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে যুগোপযোগী এবং বাংলাদেশে খুব জনপ্রিয়তাও পাচ্ছে।

আমি ঢাকার মেয়ে হলেও স্বামীর চাকুরী সূত্রে জাপানের টোকিওতে আছি। শিল্পকলা নিয়ে পড়াশোনা করায় বরাবরই আমার নিজের জন্য কিছু করার ইচ্ছা জাগে। সেই ইচ্ছা সূত্রেই আমি সহজ সোর্সিং এর কথা চিন্তা করে দেশিয় উপকরণ দিয়ে গহণা বানানোর কাজ শুরু করি। আমার উদ্যোগের নাম কাব্যে ষড়ঋতু- Kabbe Shororitu। 

প্রথমে শখের বশে করলেও বিভিন্ন অনুপ্রেরণায় একে ক্ষুদ্র উদ্দ্যোগ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা চিন্তা মাথায় আসে। আর এক্ষেত্রে Women and e- Commerce forum (WE) নামের পেজটা আমাকে আরো বেশি আগ্রহী করে তুলেছে। প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে জানলাম এটি বাংলাদেশের ৬৪ জেলার উদ্যোক্তাদের নিয়ে একটি প্লাটফর্ম, যেখানে সবাই নিজ জেলার পণ্য বা তাদের উদ্যোগের কথা তুলে ধরে। ফলে প্রতিটি জেলার প্রায় হারানো পণ্যগুলোরও নতুনভাবে পরিচিতি পাচ্ছে। এছাড়া আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এখানে সদস্যদের ই-কমার্স সম্পর্কে বিশদভাবে শেখানো হয়। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে সেমিনার, ওয়েবিনার ও প্রশিক্ষণের সুযোগ রয়েছে।

নারীদের সক্ষমতা বাড়ানো এবং উদ্যোক্তা হিসাবে নিজেকে বিকশিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে এই  Women and e-Commerce forum (WE)র  ফাউন্ডার ও প্রেসিডেন্ট হলেন নাসিমা আক্তার নিশা। তিনি এ বিষয়ে বলেন, “একটা সময় ফেইসবুক শুধুই একটা যোগাযোগ মাধ্যম ছিল, যেখানে অনেক পুরানো বন্ধুদের খুঁজে পাওয়া যেতো। 

দেশের বাইরের আত্মীয় স্বজনদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা হতো। কিন্তু বর্তমানে ফেইসবুক একটি জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে দাড়িয়েছে উদ্যোক্তাদের জন্য। ফেসবুকের মাধ্যমে উদ্যোক্তারা পণ্য কেনা বেচা করতে পারছে। যাকে আমরা এফ-কমার্স নামে জানি। সেই এফ-কমার্সের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছে আমাদের ওমেন এন্ড ই-কমার্স প্লাটফর্ম, যাকে আমরা উই বলে জানি। উই হচ্ছে দেশীয় পণ্যের একমাত্র জায়গা যেখানে আমরা হাজার হাজার নারী উদ্যোক্তাদের কে একত্রিত করতে পেরেছি। তারা তাদের পণ্য কেনা বেচা থেকে শুরু করে নেটওয়ার্কিং, নানা বিষয়ে কর্মশালা এবং ট্রেনিং এ অংশগ্রহণ পর্যন্ত করতে পারছেন। এই একটি মাত্র প্লাটফর্মে থেকে অনেকেই তাদের হতাশা কাটিয়ে সুন্দর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ও করছেন।“ 

তিনি গর্বের সাথে আরো জানান, বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশী ভাই বোনেরা দেশীয় পণ্যের কেনা কাটা করতে পারছেন, নিজেরা ব্যবহার করছেন এবং আপনজনদের কে উপহার সামগ্রী ও পাঠাচ্ছেন।

তিনি আশা করেন বিশ্বব্যাপী নারী উদ্যোক্তার এই জোয়ার টা ছড়িয়ে পরবে।

রাজীব আহমেদ Women and e-Commerce forum ( WE)’র উপদেষ্টা হিসেবে আছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রায় ২.৫ লক্ষ WE সদস্যদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসাবে পরিচিত। স্টার্টআপ থেকে শুরু করে পণ্য ডেলিভারী দেয়া পর্যন্ত কিভাবে ব্যবসায় পরিচালনা করতে হবে তা তিনি হাতে কলমে ধরে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। উনার সাথে হেঁটে অনেক উগ্যোক্তাই অনেক এগিয়ে এসেছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজনের উই নিয়ে মন্তব্য উল্লেখ করা হল:

কাকলী রাসেল তালুকদার বলেছেন, “উই হচ্ছে আমার জন্য একটা ভার্চুয়াল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একটি পবিত্র স্থান। আমি খুব লাকি যে জামদানি পণ্য নিয়ে আমার উদ্যোগ' কাকলী'স অ্যাটায়ার ' এর পথ চলার শুরুতে উই এর মতো প্ল্যাটফর্ম পেয়েছি। যে অবস্থানে যেতে আমার ৫ বছর লেগে যেতো, সেটা আমি ৯ মাসে অর্জন করতে পেরেছি। শুরু থেকে রাজিব স্যার এর উপদেশগুলো ফলো করে আসছি। প্রতিদিন শিখছি। সেজন্য স্যার এর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। ধন্যবাদ নিশা আপুকে দেশী পণ্যের নারী উদ্যোক্তাদের জন্য এমন সুযোগ তৈরি করে দেয়ার জন্য।”

নিগার ফাতেমা বলেন, “উই হচ্ছে দেশীয় পণ্যের বিশাল প্লাটফর্ম। দেশীয় পণ্যের ক্রেতা ও বিক্রেতার মিলন মেলা। উইতে শিখছি ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি এর সকল তথ্য, জানছি বাংলাদেশের ৬৪ জেলার পণ্য। আর উই এর পথ ধরেই হেঁটে যাচ্ছি একজন দেশি পণ্যের উদ্যোক্তা হয়ে। টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে কাজ করছি ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি তে। আমার অনলাইন পেইজের নাম ‘আরিয়াস কালেকশন’। চির কৃতজ্ঞ রাজিব স্যার এবং উই এর প্রেসিডেন্ট নিশা আপুর কাছে।”

তাছাড়া রাজিব আহমেদের প্রযুক্তি বিষয়ক ফেইসবুক গ্রুপ, ডিজিটাল স্কিলস ফর বাংলাদেশ আছে যেখানে বাংলায় আইটির বিভিন্ন বিষয়ে পোষ্ট পড়ে আইটি বিষয়ে অনেক কিছু জানা যাবে।

উই (WE)-এ আমি আছি প্রায় দুমাস হতে চলেছে। এই দুমাসেই আমি আমার উদ্যোগের অনেক পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। জাপানে বসেই বাংলাদেশ থেকে অনেকগুলো অর্ডার পাচ্ছি। তাছাড়া বাংলাদেশের অনেক ই-কমার্স উদ্যোক্তারা আমাকে এখন চিনতে পারছে যা আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। মোট কথা উই (WE)-তে জয়েন করে আমি অনেক লাভবান হয়েছি এবং তা শুধু আমার পণ্য বিক্রির জন্যই নয়, ই-কমার্স সম্পর্কিত অনেক বিষয়ে জ্ঞান লাভ করতে পেরেও আমি আমার উদ্যোগ নিয়ে অনেক আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছি।  

সবশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশের উদ্যোক্তদের সাফল্য অর্জনের জন্য উই(WE) এক সম্ভাবনার দ্বার হিসেবে কাজ করছে। এ বিষয়ে রাজীব আহমেদ বলেন,  “ই-কমার্সে দেশী পণ্যের প্লাটফর্মের খুব দরকার ছিল। উই সেই শূন্যতা পূরণ করতে পেরেছে। এর ফলে অনলাইনে দেশী পণ্যের প্রতি আস্থা ও বিক্রি অনেক বাড়বে আগামী ১ বছরের মধ্যে”।


   আরও সংবাদ