প্রকাশ: ৩০ জুলাই, ২০২৫ ০৬:৪৫ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক
গত বছরের শেষ নাগাদ দেশব্যাপী মানবপাচার দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিলো ৪ হাজার ২৯১টি। এসব মামলা আওতায় প্রায় ১৬ হাজার অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দায়ের করা মামলার মধ্যে মাত্র ৬৬২টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৩৮টি মামলায় দোষীদের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে পাঁচজনকে আজীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ৫৫ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়েছে। এছাড়া প্রায় ১ হাজার ২০০ জন অভিযুক্ত খালাস পেয়েছেন। নতুনভাবে ১ হাজার ৭৯টি মামলার অভিযোগ আদালতে গঠন করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানব পাচার দিবস উপলক্ষে আজ বুধবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত উচ্চপর্যায়ের এক জাতীয় সভার আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাত্তা বিভাগের উপসচিব আমিনুল ইসলামের উপস্থাপনায় এসব তথ্য উঠে আসে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ জাতিসংঘ অভিবাসন নেটওয়ার্কের ‘কাউন্টার-ট্র্যাফিকিং ইন পারসনস টেকনিক্যাল ওয়ার্কিং গ্রুপ’ এর আয়োজন করে। সেমিনারে বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য– ‘সংঘদ্ধ অপরাধ মানব পাচার, বন্ধ হোক শোষনের অনাচার।’
‘দ্য কারেন্ট সিচুয়েশন অব রেসপন্ডিং টু হিউম্যান ট্র্যাফিকিং ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই উপস্থাপনায় আরও বলা হয়, ২০১৯ সালের যুক্তরাষ্ট্রের মানবপাচার বিষয়ক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে ‘টায়ার ২ ওয়াচলিস্ট’–এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশ একই অবস্থানে অবস্থানে রয়েছে। এটি মানব পাচার প্রতিরোধে দেশের ধারাবাহিক ও দৃশ্যমান প্রচেষ্টার স্বীকৃতি। যদিও এখনও কিছু ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ মানদণ্ড পূরণে কিছু ঘাটতি রয়ে গেছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খোন্দকার মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ পাচার নির্মূলে কঠোর আইন, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা আরও গভীর করার মাধ্যমে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা আমাদের প্রচেষ্টার কেন্দ্রে থাকতে হবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাংলাদেশ মিশনের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ড. বের্ন্ড স্পেনিয়ার বলেন, মানব পাচার হলো সবচেয়ে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি। এটি একটি বৈশ্বিক অপরাধ। অনিয়মিত অভিবাসন ও মানব পাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করা ইউরোপের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার, এবং নিরাপদ, বৈধ ও মর্যাদাপূর্ণ শ্রম অভিবাসনকে উৎসাহিত করাই আমাদের লক্ষ্য। একজন মানুষ পাচারের হাত থেকে রক্ষা পেলে, একটি জীবন বাঁচে, একটি ভবিষ্যৎ পুনঃরুদ্ধার হয়।
কোইকার ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর সুজিন কং বলেন, মানব পাচার আমাদের সময়ের অন্যতম গুরুতর মানবাধিকার সংকট। যা মানুষের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও মর্যাদা কেড়ে নেয়। কোইকা বাংলাদেশ ও আমাদের অংশীদারদের পাশে থেকে এমন একটি সমাজ গঠনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যেখানে প্রত্যেকে স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারে।
বাংলাদেশে জাতিসংঘের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক সমন্বয়ক এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থার (আইওএম)চিফ অফ মিশন ল্যান্স বোনো বলেন, মানব পাচার নিয়ে শুরুতে অনেক বিতর্ক ছিলো। অনেক দেশ এটিকে নিজেদের সমস্যা বলে মানতে চাইত না। তবে সময়ের সঙ্গে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ বুঝতে পেরেছে যে, মানব পাচার একটি বৈশ্বিক সমস্যা। প্রাথমিকভাবে কে উৎস দেশ, কে গম পথ বা গন্তব্য দেশ তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এখন বোঝা যাচ্ছে যে, অনেক দেশই এই তিন ভূমিকাতেই রয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমানে মানবপাচার প্রতিরোধে অনেক অগ্রগতি হলেও চ্যালেঞ্জ এখনও বিশাল। আইএলও, আইওএম এবং ওয়াক ফ্রি ফাউন্ডেশনের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন প্রায় পাঁচ কোটির বেশি মানুষ আধুনিক দাসত্বে আবদ্ধ। যার মধ্যে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ শিশু রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, মানব পাচার এখন একটি সংগঠিত অপরাধের রূপ নিয়েছে। এটি পরিকল্পিত, মুনাফাভিত্তিক ও প্রযুক্তিনির্ভর। বিশেষ করে কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে অনলাইনে চাকরির বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে পাচার করে প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডে বাধ্য করার ঘটনা বেড়েছে। তাই প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশে নারীদের ও শিশু পাচারের ঘটনা বেশি। এই জটিল সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন সমন্বিত ও বহু-খাতভিত্তিক উদ্যোগ। সরকার, বেসরকারি খাত, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, যুব সমাজ, নাগরিক সমাজ এবং ভুক্তভোগীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি।
সেমিনার থেকে জানানো হয়, বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের মুনাফা প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার। মানবপাচার বর্তমানে ভয়াবহ ও দ্রুত বিস্তার লাভকারী সংঘবদ্ধ অপরাধে রূপ নিয়েছে। এই অপরাধচক্র শিশু, নারী ও পুরুষকে ব্যবহার করছে শ্রম শোষণ, যৌন নিপীড়ন, জোরপূর্বক বিবাহ, মাদক পাচার ও অনলাইন প্রতারণার মতো নানা অপরাধে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, বর্তমানে প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানুষ আধুনিক দাসত্বে জীবনযাপন করছে, যার মধ্যে ১২ মিলিয়ন শিশু এবং ৬১ শতাংশ নারী ও কিশোরী।