প্রকাশ: ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১১:০৭ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন মামলায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের নামও আসছে। মামলা থেকে বাদ যাচ্ছে না ব্যবসায়ী, শিক্ষক ও প্রবাসি। গাজীপুর জেলার বিভিন্ন থানায় হওয়া চারটি মামলায় পাঁচজন বিএনপি নেতাকর্মী ও বিদেশি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেও আসামি করা হয়েছে।
স্থানীয় একটি সূত্রে জানা যায়, পুলিশ ও বিএনপি নেতাকর্মীরা যোগসাজসে গাজীপুর, নারাণগঞ্জ ও আশুলিয়া এলাকার ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষকে মামলায় আসামি করছে। এছাড়া ব্যক্তিগত শত্রুতা বশে এবং দলীয় সুযোগ–সুবিধা নিতে নেতাকর্মীর নাম দিচ্ছে। গাজীপুরে রমরমা মামলা বাণিজ্য করছে তারা। প্রাথমিক এজাহার লিখে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর ফোনে পাঠিয়ে মামলা থেকে বাঁচানোর নামে মোটা অংকের অর্থ লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে।
গাজীপুরের কয়েকটি থানায় চারটি মামলায় ৩৫১ জন নমীয় আসামি। অজ্ঞাত আসামি ১৫৫০ জন। এরমধ্যে আওয়ামী লীগের পদধারী নেতাকর্মী রয়েছে ৯৪জন। বিএনপির পাঁচজন নেতাকর্মীর নামও রয়েছে। তবে তাদের পরিচয় দলীয় পদপদবীর পরিচয় গোপন করা হয়েছে। এ ছাড়া বাকি সব আসামির দলীয় পদপদবীসহ কোনো পেশাও উল্লেখ করা হয়নি এজাহারে। একটি মামলায় তিনজন পুলিশ কর্মকর্তা এবং নরওয়ের দ্বৈত নাগরিকও রয়েছে।
হত্যাসহ বিভিন্ন মামলায় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতা থেকে শুরু করে ওয়ার্ড নেতাকর্মীদের নামে মামলা হয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য ও গাছা থানা যুবলীগের সেক্রেটারি মশিউর রহমান মশি এবং গাছা থানা সেচ্ছাসেবক লীগ নেতা বিল্লাল হোসেনের নামে কোনো মামলা হয়নি। তারা স্থানীয় বিএনপি নেতাদের অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ করে মামলা থেকে বেঁচে গেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে কোটা বিরোধী আন্দোলেন গাছা থানায় চারজনের মারা যাওয়ার ঘটনায় ভুক্তভোগীরা ওসিসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে কয়েক দফায় মামলা করতে গেলেও পুলিশ সেই মামলা নেয়নি বলে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ।
একই অবস্থা বাসন থানায়ও। স্থানীয় কয়েকজন সুবিধাবাদি বিএনপি নেতা টাকার বিনিময়ে মামলা বাণিজ্যের নামে যা–ইচ্ছে তাই করছেন। মামলা হওয়ার আগেই ড্রাফট পাঠিয়ে টাকা দাবি করছেন কেউ কেউ। বিশেষ করে ১৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা এই সুবিধা পাচ্ছেন সবচেয়ে বেশি। ওয়ার্ডের সাংগঠনিক সম্পাদক মিনহাজ ও তার গ্রুপের বিরুদ্ধে এলাকায় গত কয়েক বছর সন্ত্রাসী ও ত্রাস করার অভিযোগ থাকলেও মহানগর বিএনপির একজন নেতা টাকার বিনিময়ে এই গ্রুপকে মামলা থেকে নিরাপদ দুরত্বে রাখছেন। এমনকি এই গ্রুপের দখলে থাকা ঝুট ব্যবসাও ভাগাভাগি করে বিএনপি নেতারা মিলেমিশে খাচ্ছেন। সরকার পতনের পরও সন্ত্রাসী এই গ্রুপটি মারধর এবং হুমকি-ধামকি দেয়ায় থানায় জিডি হয়েছে। কতটা দু:সাহস থাকলে ক্ষমতার পালাবদলেল পর সন্ত্রাসী গ্রুপটি হুমকি ধামকি দিতে পারে?
এদিকে ঘটনাস্থল থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে বসবাসকারী নরওয়ে অসলো বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সহযোগী অধ্যাপক নুরুল ইসলাম শেখের নামে হত্যা মামলা হয়েছে। নুরুল ইসলাম শেখ কান্না জড়িত কণ্ঠে সমকালকে বলেন, আমি ১৯৯৪ সাল থেকে বিদেশে থাকি। লেখাপড়া শেষ করে নরওয় অসলো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা করি। আমিসহ আমার স্ত্রী ও তিন সন্তান সবাই নরওয়ের নাগরিক। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে পরিবার নিয়ে দেশে আসি। দেশে এসেই হয়েছেন হত্যা মামলার আসামি। এসব মারামারি ও সংঘর্ষের কোনো কিছুই জানি না। কোটা বিরোধী আন্দোলনে সংঘর্ষে মারা যাওয়ার ঘটনায় গাজীপুরের গাছা থানার একটি মামলায় আমাকে আসামি করা হয়েছে।
নুরুল ইসলাম বলেন, মামলার বাদি আমাকে চিনে না, আমিও তাকে চিনি না। এখানে আমার নাম পরিচয়সহ মামলায় ৫০ নম্বর আসামি করা হয়েছে। দেশে এসেই এটাই যদি আমার পাওয়ার থাকে! তাহলে দেশের সম্পদ বেঁচে দিয়ে একেবারে বিদেশ চলে যেতে হবে। আমরা চাই দেশের জন্য কিছু করি, দেশকে কিছু দেই। কিন্তু পারলাম কোথায়? এটার শেষ কোথায়? গত বছরও নরওয়ে থেকে ৪৪ লাখ টাকা দেশে রেমিটেন্স পাঠিয়েছি। কে বা কারা রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের নামে মামলা দিচ্ছে। সেটা তদন্ত করে বের করা উচিত সরকারের।
একই মামলার ৭০ নম্বর আসামি সাবেক ছাত্রদল নেতা জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি বলেন, আমি জয়দেবপুর ১ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি ছিলাম। ২০১২ সালের পর ব্যবসায় মনযোগী হই। আমার বাবা মৃত মাইন উদ্দিন মেম্বর ছিলেনও জয়দেবপুর ১ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি। এছাড়া পুরো পরিবার বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে সম্প্রত। তারপরও কিসের জন্য আমার নাম হত্যা মামলা হলো সেটা অজানা। যেই মামলায় আমাকে আসামি করা হয়েছে, সে বিষয়ে আমি কিছু জানিও না।
গাজীপুর গাছা থানায় ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে ২৪ আগস্ট একটি হত্যা মামলা করেন ইনছার আলী। যেই মামলায় আসামি হলেন নুরুল ইসলাম শেখ ও জাহাঙ্গীর হোসেন। ইনছার আলী বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং সাবেক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নামে মামলা করেছি। তাদের নির্দেশে আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। এর বাইরে আর কোনো আসামিকে আমি চিনি না, জানি না। পুলিশ কার নাম দিয়েছে, তাও আমার জানা নেই।
হত্যার মামলার বাদির এমন বক্তব্যের পর গাজীপুর গাছা থানার সেই মামলার এজাহার বিশ্লেষণ করা হয়। সেখানে বাদি ইনছার আলী উল্লেখ করেছেন, গত ২০ জুলাই দুপুরের দিকে আমার ছেলে রাজমিস্ত্রী মঞ্জু মিয়াকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা গুলি করে হত্যা করে। ওই ঘটনায় ২৪ আগস্ট গাছা থানায় হত্যা মামলা হয়। সেই মামলায় শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান, জাহিদ আহসান রাসেল, টিপু মন্সী, সাবেক পুলিশ প্রধান চৌধুরী আব্দুল্লাল আল–মামুন, সাবেক ডিবি প্রধান হারুন অর–রশীদসহ ৮৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এজাহারে ৩৬ জন আসামির দলীয় পদপরিচয় উল্লেখ করা হয়নি।
এক সময় বিএনপির পেশাজীবি নেতা ছিলেন। তবে রাজনীতির রোষানল থেকে বাঁচতে আওয়ামীলীগে যোগ দেন। এই ব্যাক্তির নাম ইঞ্জিনিয়ার মমতাজ উদ্দিন (৭০)। থাকেন গাজীপুরে। তবে উত্তরা পশ্চিম থানায় হত্যা মামলার আসামী হয়েছেন।
ব্যবসায়ী ফারুক হোসেনের নামেও হত্যা মামলা
গাছা থানার আরেকটি হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে কামিশপুর থানা বিএনপির সাবেক দুই বারের আহ্বায়ক এবং গাজীপুর জেলা বিএনপির সাবেক সদস্য ও গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ফারুক হোসেনকে। এ বিষয়ে বাদি রজ্জর আলী বলেন, শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদের ছাড়া কারোর নামে মামলা করিনি। ছেলে খুনের দ্বায়ে আমি তাদের বিচার চাই। এছাড়া যেসব পুলিশ তাকে গুলি করেছে, তাদেরও বিচার দেখতে চাই। মামলার বাকি আসামিদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিশ্বাস করেন, আমি দুইজনের ছাড়া কাউকে চিনিও না এবং আসামিও করিনি।
হত্যা মামলার আসামি বিএনপি নেতা ফারুক হোসেন বলেন, গাজীপুর মহানগরের এক প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে দীর্ঘদিন মনমালিণ্য রয়েছে। এ জন্য গাছা থানার হত্যা মামলায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমাকে আসামি করা হয়েছে। এই সময়ে যে যার উদ্দেশ্য হাসিল করছে। তিনি হয়তো ভাবছেন, আমি জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারি, এই আশঙ্কা থেকেই চাপে ফেলতে হয়তো, এই মামলায় আসামি করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমি সর্বশেষ গাজীপুর জেলা বিএনপির সদস্য ছিলাম। তার আগে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত কুনায়াবাড়ী ইউনিয়ন ছাত্র দলের সাধারণ সম্পাদক; ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত গাজীপুর সদর থানা ছাত্র দলের সাংগঠনিক সম্পাদক; ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত জেলা ছাত্র দলের সদস্য; ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত কাশিমপুর ইউনিয়নের বিএনপির দুইবার আহ্বায়ক এবং ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত জেলা বিএনপির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব ছিলাম। এরপর ২০১০ সাল থেকে গার্মেন্টেস ব্যবসায় শুরু করি। পুরো পরিবারও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
মামলা বাণিজ্যের অভিযোগ অস্বীকার করে গাছা থানার ওসির জুয়েল ইসলাম সমকালকে বলেন, এটা সত্য নয়। বাদি যাদের নামে উল্লেখ করেছে, তাদেরই আসামি করা হয়েছে। তবে বাদি এজাহারের প্রথমসারির কয়েকজনকে চিনলেও বাকিদের চিনে না, এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি কোনো মন্তব্য করেনি। বাদি আদালতে মামলা প্রত্যাহারের আবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা আদালতের বিষয়।
কাশিমপুরে বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে মামলা
গাজীপুর কাশিমপুরের লঙ্কাচারা ২ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সদস্য হয়রত আলী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন মামলা ও হামলার শিকার হয়েছি। এখন যাই একটু দেশের অবস্থা ভালোর দিকে, তখন নিজ দলের প্রতিহিংসার শিকার হতে হচ্ছে। মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কাশেমপুর থানায় একটি হত্যা চেষ্টা মামলায় আমার বড় ভাই বিল্লাল খানের নাম জড়িয়েছে। তিনি বলেন, বিষয়টি বিএনপির ঊধ্বর্তন নেতাদের জানানো হয়েছে। তারা দেখবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। তবে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখি নাই।
হত্যার উদ্দেশ্যে হামলার অভিযোগ এনে গাজীপুর কাশিমপুর থানায় ২১ আগস্ট একটি মামলা করেন সোহেল রানা নামে এক ভুক্তভোগী। তিনি এজাহারে উল্লেখ করেন, ৪ আগস্ট বিকেল ৪টার দিকে কাশিমপুর চক্রবর্তী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় গুলিবিদ্ধ হই। সেখানে কাশিমপুর থানা আওয়ামী লীগের সহ–সভাপতি শওকত হোসেন মন্ডল অবৈধ পিস্তাল দিয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে এলোপাথারি গুলি ছুড়লে সোহেল নিজে ও সানাউল্লাহসহ অসংখ্য ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়। এই সানাউল্লাহ স্থানীয় এক বিএনপির সমার্থকের ভাগিনা। তার নেতৃত্বে ত্যাগী নেতাদের নামে মামলা হচ্ছে।
এদিকে অটোরিকশা চালক লিমন মন্ডল কাশিমপুর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাবেক সহ–সভাপতি ফারুক হোসেন ও সক্রিয় কর্মী সাহাদাৎ হোসেনসহ ৯৫ জনের নাম উল্লেখ করে হত্যাচেষ্টা মামলা করে। তিনি এজাহারে উল্লেখ করেছেন, ২ আগস্ট চক্রবর্তী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় কাশিমপুর থানা আওয়ামী লীগের সহ–সভাপতি শওকত হোসেন মন্ডলের ছোড়া গুলিতে আহত হয়।
এ বিষয়ে হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি সাহাদাৎ হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় জ্বালাও–পোড়াও মামলার আসামি হয়েছি। এখন দলের প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছি। স্থানীয় এক ব্যক্তি এসব কারাচ্ছে। এতে দলের মধ্যে কোন্দল প্রকাশে আসছে।
গাজীপুর মহানগর বিএনপির সভাপতি শওকত হোসেন সরকার বলেন, গাজীপুরে বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে বলে শুনেছি। যেসব মামলায় বিএনপির নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়েছে, তাদের বিষয়টি পুলিশের সঙ্গে কথা হয়েছে। এছাড়া মামলা করার ক্ষেত্রে আর যাতে দলীয় নেতাকর্মীরা ভোগান্তির শিকার না হয়, সেদিকে পুলিশ ও বিএনপি নেতাদের সর্তক করা হয়েছে।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (প্রশাসন) জিয়াউল হক সমকালকে বলেন, এমন মামলা হলে, যিনি তদন্তকারী কর্মকর্তা থাকবেন, তিনি বিষয়টি দেখবেন। তার তদন্তে যেটা আসবে, তিনি সেই অনুযায়ী আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা করবেন। এ ছাড়া ভূয়া মামলা বিষয়ে সর্তক থাকতে বলা হয়েছে পুলিশ সদস্যদের।