প্রকাশ: ২৯ অগাস্ট, ২০২৪ ১২:৩১ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক: ‘জীবন্মৃত হয়ে থাকার চাইতে মরে যাওয়াই ভালো’। মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে রাহানুমা সারাহ (৩২) ফেসবুকে এমনই একটা পোস্ট দেন। তার এক ঘণ্টা আগে বন্ধু ফাহিম ফায়সালকে নিয়ে আরেকটি পোস্ট করেন তিনি। সেখানে তিনটি ছবি পোস্ট করে ক্যাপশনে লিখেছেন– ‘তোমার মতো বন্ধু পেয়ে ভালো লাগলো। ঈশ্বর তোমাকে সর্বদা মঙ্গল করুন। আশা করি, শিগরিই তোমার সব স্বপ্ন পূরণ হবে। আমি জানি আমরা একসঙ্গে অনেক পরিকল্পনা করেছি। দুঃখিত, আমাদের পরিকল্পনা পূরণ করতে পারছি না। ঈশ্বর তোমার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আশীর্বাদ করুন’। এর তিনদিন আগে নিজের ফেসবুকে প্রোফাইলের ছবিও পরিবর্তন করে সেখানে ‘টাইম টু স্যে গুডবাই’– লেখা কার্ড দেন।
গত মঙ্গলবার রাত পৌনে ২টার দিকে রাজধানীর হাতিরঝিল লেক থেকে রাহানুমা সারাহকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে কয়েকজন পথচারী। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত্যু ঘোষণা করেন। সারাহ্ বেসরকারি টেলিভিশন জিটিভির নিউজরুম এডিটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০২১ সালের শেষের দিকে জিটিভিতে যোগদান করেন। এর আগে এনটিভি অনলাইনে নিউজরুম এডিটর ছিলেন। তাদের বাড়ি নোয়াখালী মাইজদী সদরে। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সারাহ্ দ্বিতীয় ছিলেন। তাঁর বাবা বখতিয়ার শিকদার মাইজদী প্রেসক্লাবের বর্তমান সভাপতি।
মৃত সারাহর স্বামী সায়েদ শুভ্র বলেন, ঢাকার কল্যাণপুরের একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন তারা। প্রেমের সম্পর্কের সূত্র ধরে সাত বছর আগে তারা পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ে করেন। মঙ্গলবার সারাহ অফিসে গিয়ে রাতে আর বাসায় ফেরেননি। এক ব্যক্তিকে দিয়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে বাসা ভাড়ার টাকা পাঠিয়ে দেন। পরে তাকে ফোন করলে ‘ব্যস্ত আছি’ বলে ফোনের লাইন বিছিন্ন করে দেয়। রাত ৩টার দিকে খবর পাই, সে হাতিরঝিল লেকের পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে।
শুভ্র বলেন, ‘আমাদের মধ্যে মনমালিণ্য হয়নি, কিছুদিন আগ থেকে সারাহ আলাদা হতে চাচ্ছিলেন। পরে আমরা দুজনই কাজী অফিসে গিয়ে বিবাহবিচ্ছেদ করবো বলে সিদ্ধান্ত হয়। দেশের এই পরিস্থিতিতে আর কাজী অফিসে যাওয়া হয়নি।’
গতকাল বুধবার ডিএমপির হাতিরঝিল থানার ওসি মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, হাতিরঝিল লেকের পানিতে একজনের নিথর দেহ ভাসতে দেখে পথচারীরা উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে তাঁকে মৃত ঘোষণা করে চিকিৎসক। তবে এটা আত্মহত্যা না কী হত্যা, তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতে ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলেই মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে।
তিনি বলেন, এই ঘটনায় মৃতের বাবা বখতিয়ার শিকদার হাতিরঝিল থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করেছে। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। স্বামীর বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন, পরিবারে সদস্যরা অবিবাহিত বলে দাবি করেছেন। এছাড়া স্ত্রীর পরিচয়ে কেউ থানায় এসে অভিযোগও দেয়নি। তবে আমরা তদন্তের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আসবো।
হাতিরঝিল থানা পুলিশ সারাহ্ মৃত দেহের সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, মৃতের মৃত্যুর সুনিদিষ্ট কোনো কারণ জানা যায়নি। তার শরীরে কোনো আঘাত বা জখমের চিহ্ন নেই। এছাড়া যৌন নিপিড়নের কোনো আলামতও পাওয়া যায়নি।
মৃত রাহানুমা সারাহর বড় বোন জামাই বেসরকারী ব্যাংকের কর্মকর্তা মোহাম্মদ আসিফুল বারী বলেন, আমি পরিবার নিয়ে শ্যামলীতে থাকি। আর সারাহ্ কল্যাণপুর থাকত। সেখানে বাসা ভাড়া নিয়ে একাই থাকত বলে জানতাম। তবে তার বাসায় কখনো আমরা যায়নি। সে বোনের বাসায় যাওয়া আসা করত। তবে আজকে শুনছি– সারাহ বিবাহিত ছিলেন, কিন্তু এ বিষয়ে কিছুই বলতি পারছি না। পুলিশের তদন্তে প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে বলে মনে করছি।
তিনি বলেন, বিকেলে ময়নাতদন্ত শেষে পুলিশ মরদেহ হস্তান্তর করে। তাকে ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
জিটিভির হেড অব নিউজ ইকবাল করিম নিশান সমকালকে বলেন, ‘মঙ্গলবার সারাহ অফিসে এসে কোনো কাজ করেননি। বিকেলের দিকে অফিসে এসে বেতন তুলে কিছু সময় থেকে চলে যায়। রাতে তার মৃত্যুর খবর পেয়ে সহকর্মীরা হাসপাতালে ছুটে যাই। একজন মেধাবী সাংবাদিকে এমন মৃত্যুতে জিটিভি পরিবারের পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করছি।’
সাংবাদিক সারাহ্ মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়েতেই তার বন্ধু ও সহকার্মীরা তাকে নিয়ে ফেসবুকে বিভিন্ন পোস্ট করেছেন। সেখানে বন্ধু ও পরিচিতজনরা সারাহ ডিপ্রেশনে (মানসিক অবসাদ) ভুগছিলেন বলে দাবি করেন। মৃত্যুর আগে সারাহ্ যেই বন্ধু ফাহিমকে নিয়ে পোস্ট করে। তিনি মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার পর তাঁর ফেসবুকে লেখেন— ‘আমার বন্ধুটা আর নেই, কাল রাতে শেষ কথা আমার সাথেই হয়েছিল। যদি বুঝতে পারতাম এটাই আমাদের শেষ কথা তাহলে কখনই যেতে দিতান না!’
এছাড়া সারাহর বন্ধু সৈয়দ নাজমুস সাকিব তার ফেইসবুকে লিখেছেন, ‘সারাহ অনেকদিন থেকে ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন, চিকিৎসাও নিয়েছিলেন। সবাই তাকে আশ্বস্ত করেছিল যে তিনি ঠিক হয়ে যাবেন।’
সারাহর মৃত্যুতে শোকাস্তব্ধ বন্ধু চিকিৎসক মেজবাহ উল আজিজ লিখেছেন, ‘যে ডিপ্রেশনের জন্য আমরা লড়াই করতে চেয়েছিলাম, সেই ডিপ্রেশনের কাছেই আজ আমরা আবার হারলাম। সুইসাইড প্রজেক্টে কাজ করতে চাওয়া, ডিপ্রেশন এর রাস্তা থেকে ফিরিয়ে আনতে চাওয়ার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে হাতিরঝিলের পানিতে নিথর ভেসে আছে আমাদের অপরাজিতা হসন্ত।’