ঢাকা, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২০ মহররম ১৪৪৬

বাংলাদেশের জনগণকে স্যালুট, প্রধানমন্ত্রী


প্রকাশ: ২৬ জুন, ২০২২ ০১:২৬ পূর্বাহ্ন


বাংলাদেশের জনগণকে স্যালুট, প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশ মাথা নত করেনি। শত বাধা, চাপের মুখে ধীরে কিন্তু দৃঢ়ভাবে এগিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। 'আমরাও পারি'- আগামীর শক্তি হয়ে ওঠার এ বার্তা বিশ্বকে দিয়ে নিজের টাকায়, মেধায় প্রমত্ত পদ্মায় গর্বের সেতু নির্মাণ করেছে। এমন দিনের জন্যই হয়তো তারুণ্যের কবি, দ্রোহের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন, 'সাবাস, বাংলা দেশ,/ এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়ঃ।' যাঁর সাহসে 'সম্ভব না' থেকে সম্ভাবনার পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কণ্ঠে ধ্বনিত এ কবিতা প্রতিধ্বনিত হলো পদ্মাপাড় থেকে সারাদেশে। বাকি সবাই দিলেও সেতুর কৃতিত্ব নিজে নিলেন না; দিলেন বাংলার জনগণকে। পদ্মা সেতুর বহুল প্রতীক্ষার উদ্বোধনে বললেন, 'এই জনগণই আমার সাহসের ঠিকানা, এই জনগণকে আমি স্যালুট জানাই।'

দুই যুগের অপেৃৃৃৃৃৃৃৃক্ষার অবসান হয় গতকাল শনিবার ভরদুপুরে। ভরা বর্ষায় পদ্মা যেমন থাকে, গতকালও তেমনই ছিল। উত্তাল প্রমত্ত। সেই খরস্রোতা নদীর ওপর যে সেতু নির্মাণে ২১ বছর আগে তিনি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। আজ টোল দিয়ে সেই তিনিই পদ্মা পার হন প্রথম যাত্রী হিসেবে। বাঙালির অহংকারের সেতুতে দাঁড়িয়ে উতল হাওয়ার বিপরীতে দাঁড়ান গর্ব নিয়ে। যেমন বিরুদ্ধ হাওয়ার বিপরীতে নৌকা বেয়ে এক যুগে তিলে তিলে সত্য করেছেন পদ্মা সেতু নির্মাণের স্বপ্নকে। বাতাসে এলোমেলো করে দেওয়া কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের চুল সামলে নিতে নিজের মাথার কাঁটা খুলে দেন মায়ের মমতায়। এমনভাবেই এক যুগ ধরে ঝোড়ো হাওয়ায় আগলে রেখেছিলেন পদ্মা সেতু প্রকল্পকে।

পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের দিনক্ষণ গণনা চলছিল অনেক দিন ধরেই। গতকাল ছিল সেই দিন, সেই ক্ষণ। সকাল সাড়ে ৯টায় প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী হেলিকপ্টার পৌঁছে পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে। সেখানে সরকারপ্রধান যোগ দেন সুধী সমাবেশে। যাঁদের মেধায় ঘামে নির্মিত হয়েছে পদ্মা সেতু- সেই প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলামসহ কর্মকর্তা ও কর্মীদের সঙ্গে ছবি তোলেন শেখ হাসিনা।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে সুধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পঁচাত্তরে মা-বাবা, ভাইসহ পরিবারের প্রায় সবাইকে হারিয়ে ৬ বছর রিফিউজি জীবন কাটিয়ে একাশি সালে দেশে ফেরেন। আওয়ামী লীগ তাঁকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করলে একরকম জোর করে দেশে ফিরে আসেন। জনগণই তাঁকে আপন করে নেয়। আর তিনি যখন জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন, তখনও জনগণই এগিয়ে আসে; তাঁকে সাহস ও শক্তি জোগায়।

পদ্মা সেতুকে বাংলাদেশের গর্ব, সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক আখ্যা দিয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন, আজ পদ্মার বুকে জ্বলে উঠেছে লাল, নীল, সবুজ, সোনালি আলোর ঝলকানি। সেতুর ৪১টি স্প্যান যেন স্পর্ধিত বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। আজ বাংলাদেশের মানুষ গর্বিত। অনেক বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে এবং ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে সমর্থ হয়েছি। এই সেতু শুধু ইট-সিমেন্ট-স্টিলের অবকাঠামো নয়, এ সেতু আমাদের অহংকার, আমাদের গর্ব, আমাদের সক্ষমতা আর মর্যাদার প্রতীক। এই সেতু বাংলাদেশের জনগণের।

সরকারপ্রধান বলেছেন, ষড়যন্ত্রের কারণে সেতু নির্মাণে বিলম্ব হয়েছে বটে; কিন্তু হতোদ্যম হননি, হতাশায় ভোগেননি। জাতির পিতার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের সেই অমোঘ মন্ত্র 'কেউ দাবায়া রাখতে পারবা না'র পুনরোল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি, আমরা বিজয়ী হয়েছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কখনও মাথা নোয়াননি, তিনি আমাদের মাথা নোয়াতে শেখান নাই, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও তিনি জীবনের জয়গান গেয়েছেন।

শেখ হাসিনার সাহসিকতা ছাড়া সেতু নির্মাণ সম্ভবই ছিল না জানিয়ে সুধী সমাবেশে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল বলেন, গত ১১ বছর প্রধানমন্ত্রী দৃঢ় প্রত্যয়, দূরদর্শিতা এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নইলে এই সেতু নির্মাণে বিশ বছর সময় লাগত। খরচ হতো ১৫ বিলিয়ন ডলার।

সুধী সমাবেশের শুরুতেই বরেণ্য শিল্পীদের অংশগ্রহণে পদ্মা সেতুর থিম সং পরিবেশিত হয়। প্রদর্শিত হয় প্রামাণ্যচিত্র। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী স্মারক ডাকটিকিট, স্যুভেনির শিট, উদ্বোধনী খাম ও সিলমোহর এবং ১০০ টাকা মূল্যের স্মারক নোট অবমুক্ত করেন। পদ্মা সেতুর ঠিকাদারের পক্ষে সরকার প্রধানকে পদ্মা সেতুর রেপ্লিকা উপহার দেওয়া হয়।

সমাবেশে স্পিকার, মন্ত্রিসভার প্রায় সব সদস্য, সংসদ সদস্য, তিন বাহিনীর প্রধান, মুখ্য সচিবসহ প্রায় সব ঊর্ধ্বতন আমলা, পুলিশ প্রধানসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাসহ প্রায় সাড়ে তিন হাজার অতিথি অংশ নেন। ছিলেন আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা। তবে আমন্ত্রণ পেলেও বিএনপি নেতারা যাননি পদ্মা সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে। ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের দূত এবং বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি।

সুধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাওয়া প্রান্তে ম্যুরাল উন্মোচন করেন। সেখানে দোয়া-মোনাজাত করা হয়। এরপর সেতুর উদ্বোধনী ফলক উন্মোচনের পর মেয়ের সঙ্গে সেলফি তোলেন সরকার প্রধান। সেলফি তোলা শেষে প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কলে যুক্ত হন। ভিডিও কলেই মোবাইল ঘুরিয়ে হাসিমুখে পুরো এলাকা দেখান তিনি। প্রধানমন্ত্রী যখন ভিডিও কলে কথা বলা শুরু করেন, তখন পুতুলকে দেখা যায় ক্যামেরা হাতে মায়ের ছবি তুলতে। এরপর পুতুলকে ডেকে নেন প্রধানমন্ত্রী, একসঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলেন।

এ সময় তিনি পাশে ডেকে নেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে। তাঁরা দু'জনসহ আরও কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কথিত দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার চুক্তি করেও তা বাতিল করা হয়েছিল।

স্বনামধন্য ব্যক্তি বিশেষের ষড়যন্ত্রে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধে বিশ্বব্যাংকের পদক্ষেপ এবং তাঁকে, তাঁর বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ, ভাগ্নে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকী এবং মন্ত্রী আবুল হোসেন, উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান ও মোশাররফ হোসেনসহ সংশ্নিষ্টদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ দেওয়ার অপচেষ্টাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তা মোকাবিলার ইতিবৃত্ত সুধী সমাবেশে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ তুলে যাঁদের চরম মানসিক যন্ত্রণা দেওয়া হয়েছিল তাঁদের সহমর্মিতা জানান। ষড়যন্ত্রকারীদের আগামীতে দেশপ্রেম জাগ্রত হবে, মানুষের প্রতি দায়িত্বশীল হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন।

দোয়া-মোনাজাতের পর ১১টা ৪৯ মিনিটে প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি টোল দিয়ে সেতুতে ওঠে। অতিক্রম করার সময় মাঝ বরাবর নেমে সেতু ও পদ্মার উত্তাল তরঙ্গ প্রত্যক্ষ করেন শেখ হাসিনা। তখনও তাঁর পাশে ছিলেন সৈয়দ আবুল হোসেন। প্রধানমন্ত্রী সেতুতে দাঁড়িয়ে বিমানবাহিনীর মনোজ্ঞ ডিসপ্লে উপভোগ করেন। যুদ্ধবিমান থেকে রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশে লাল-সবুজ আবির ছড়িয়ে যেন যুদ্ধজয়ের আনন্দবার্তাই দিচ্ছিল। ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু পেরিয়ে ১২টা ৩৪ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী পৌঁছান শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে।

প্রধানমন্ত্রীর বহরের পর মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য, রাজনীতিক, আমলা ও কূটনীতিকদের নিয়ে ১৩টি বাস পদ্মা সেতু পার হয়। বাসে যাত্রী হওয়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেছেন, পদ্মা সেতু পার হওয়ার মুহূর্ত শুধু আনন্দের নয়, গর্বেরও।

পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে গতকাল মাওয়ায় জনসমাগমে নানা বিধিনিষেধ ছিল। যান চলাচল বন্ধ রাখা হয় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে নামে পরিচিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়কে। তারপরও হাজারো মানুষের ভিড় জমে মাওয়ায়। সাধারণ যান চলাচল বন্ধ থাকায় দূরদূরান্ত থেকে তাঁরা হেঁটে আসেন। প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতুর প্রান্তে রওনা হওয়ার পর অগণিত মানুষের ভিড় সেতুর দিকে রওনা হয় হেঁটে। নিরাপত্তা বাধা ঠেলে তাঁদের টাকায় বানানো গর্বের সেতুতে ওঠেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেতুর নিরাপত্তায় তাঁদের নামিয়ে দিলেও আজ রোববার সকাল ৬টা থেকে সাধারণ মানুষের যানবাহনের জন্যও উন্মুক্ত হচ্ছে পদ্মা সেতু।


   আরও সংবাদ