প্রকাশ: ১১ জুন, ২০২২ ১৫:১০ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক: সম্প্রতি ঢাকার আশুলিয়ায় হানিফ পরিবহন ও গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে স্টার লাইন পরিবহনের বাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ওই দুইটিসহ বিভিন্ন সময়ে দূরপাল্লার বাসে ডাকাতির সঙ্গে জড়িত আন্তঃজেলা ডাকাত দলের ১০ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। গ্রেপ্তারের সময় তারা ডাকাতি প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বলে জানিয়েছে র্যাব। এ সময় তাদের কাছ থেকে দেশি ও বিদেশি অস্ত্র জব্দ করা হয়।
গতকাল শনিবার রাতে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে ঢাকার আশুলিয়া এলাকা থেকে র্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৮ এর একটি অভিযানিক দল তাদের গ্রেপ্তার করে।
রোববার সকালে কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
র্যাব বলছে, এই ডাকাত চক্রটি গত দেড় বছরে যাত্রীবেশে মহাসড়কে ১৫টির বেশি ডাকাতি করেছে। চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। কারাগারে গিয়ে তারা জামিন নিয়ে এসে আবারও ডাকাতির কাজে লিপ্ত হন। এছাড়া ঢাকা-দিনাজপুরগামী একটি বাসে ডাকাতির সময় ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটান তারা।
গ্রেপ্তাররা হলেন- ওই ডাকাতচক্রের সর্দার হিরা শেখ ওরফে কালাম শেখ ওরফে সোলেমান শেখ, হাসান মোল্লা ওরফে ইশারত মোল্লা, আরিফ প্রামাণিক ওরফে আরিফ হোসেন, নুর ইসলাম, রাজু শেখ ওরফে রাজ্জাক, রেজাউল সরকার, রতন, শরিফুল ইসলাম, হানিফ ও নজরুল ইসলাম। এ সময় তাদের কাছ থেকে ডাকাতিতে ব্যবহৃত একটি বিদেশি পিস্তল, তিন রাউন্ড গুলি, আটটি দেশি অস্ত্র, শ্যামলী এনআর ট্রাভেলসের চারটি টিকিট ও তিনটি ব্যাগ উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতাররা ঢাকা-রাজশাহীগামী একটি বাসে ডাকাতির পরিকল্পনা করছিলেন।
এই কর্মকর্তা জানান, গত ২৯ মে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে ঢাকা হতে গোপালগঞ্জগামী স্টার লাইন পরিবহনে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় গত ০৮ জুন ডাকাত মহব্বত রয়েলকে লুন্ঠিত মালামালসহ রাজশাহী থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। ডাকাত রয়েলকে জিজ্ঞাসাবাদে র্যাব গোয়েন্দারা বিভিন্ন ডাকাতির ঘটনা সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য পায়। র্যাব জানতে পারে ডাকাত হীরার নেতৃত্বে এই সংঘবদ্ধ ডাকাত দলটি গত ০১ মাসে ০৩টি দুরপাল্লার বাসে দুর্ধর্ষ ডাকাতি করে। দুর্ধর্ষ এই ডাকাত চক্রটি গত ১১ মে চট্টগ্রাম হতে যশোর বেনাপোলগামী হানিফ পরিবহন, ২৫ মে ঢাকা-রাজশাহীগামী ন্যাশনাল ট্রাভেলস পরিবহন এবং ২৯ মে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে ঢাকা হতে কোটালীপাড়াগামী স্টার লাইন পরিবহনে ডাকাতি করে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তাররা জানায়, তারা একটি সংঘবদ্ধ ডাকাত চক্র। এই দলের সদস্য সংখ্যা ১২/১৫ জন। গ্রেফতারকৃত ডাকাত সর্দার হীরা ও তার অন্যতম সহযোগী হাসান মোল্লা বিভিন্ন ডাকাতির পরিকল্পনা করে থাকে। ডাকাত দলটি দীর্ঘদিন যাবত ঢাকা হতে দেশের বিভিন্ন জেলামুখী যাত্রীবাহী বাসে উঠে ডাকাতি করে আসছিল। বিগত ২ বছরে তারা প্রায় ১০-১৫টি বাসে ডাকাতি করেছে। ইতোপূর্বে চক্রটি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে শ্যামলী পরিবহন ও মামুন ট্রাভেলস, ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে ন্যাশনাল ট্রাভেলস ও একতা ট্রাভেলস এ ডাকাতি করে বলে জানায়।
এছাড়া, চট্টগ্রাম-সিলেট মহাসড়কে সৌদিয়া বাসে ডাকাতির সময় তারা বাস চালকের হাতে ও হেলপারের পেটে ছুরিকাঘাত করে। এছাড়াও এই চক্রটি ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে ফাল্গুনী ট্রাভেলস, সুন্দরবন এক্সপ্রেস ও কণক পরিবহন, ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে সুরভী পরিবহন, হানিফ পরিবহন, সিলেট-রাজশাহী মহাসড়কে শ্যামলী পরিবহন ও রইস পরিবহন, ঢাকা-পাবনা মহাসড়কে পাবনা এক্সপ্রেস ও সরকার ট্রাভেলস, রাজশাহী-বরিশাল মহাসড়কে সেবা গ্রীন লাইন পরিবহন ও তুহিন পরিবহনে ডাকাতি করে।
বিগত ৩ বছর পূর্বে ঢাকা-দিনাজপুরগামী একটি বাসে ডাকাতির সময় ধর্ষনের মত ঘটনা ঘটায় বলে জানায়। সর্বশেষ তারা ঢাকা হতে গোপালগঞ্জগামী স্টার লাইন পরিবহনে ডাকাতি করে। ডাকাতির জন্য তারা ঢাকা হতে দেশের বিভিন্ন দূরপাল্লার আন্তঃজেলা বাস সমূহকে টার্গেট করে। এক্ষেত্রে চক্রটির কয়েকজন পূর্ব থেকেই কাউন্টার হতে টিকেট ক্রয়ের মাধ্যমে বাসে ওঠে। অন্য সদস্যরা পরবর্তী বিভিন্ন কাউন্টার থেকে টার্গেটকৃত বাসে ওঠে।
এছাড়াও, যে সকল দূরপাল্লার বাস কাউন্টার ব্যতিত যাত্রী উঠায় তারা এই সকল বাসকে প্রাধান্য দিয়ে ডাকাতি করে থাকে। সাধারণত তারা মহাসড়কের নির্জন এলাকায় বাস ডাকাতির জন্য বেছে নেয়। ডাকাতি করার পর তারা পুনরায় আশুলিয়ায় ফিরে আসে। এছাড়াও, বিভিন্ন সময় তারা বাড়ি ঘরে ডাকাতি করত বলে জানা যায়। ইতোপূর্বে গ্রেফতারকৃত সকলেই ডাকাতিসহ অন্যান্য মামলায় ২-৬ বছর মেয়াদে কারাভোগ করেছে।
আসামিদের অবস্থান-
গ্রেফতার হিরা শেখ’কে জিজ্ঞাসাবাদে জানায় যে, সে উক্ত ডাকাত চক্রের অন্যতম মূল হোতা। পূর্বে সে গার্মেন্টস পণ্য বিক্রির সাথে জড়িত ছিল। পরে ডাকাতির পেশায় জড়িয়ে পড়েন। দীর্ঘ ১০/১২ বছর যাবৎ ডাকাতি করে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি বাস ডাকাতির ঘটনা তার নেতৃত্বে সংঘঠিত হয়েছে। প্রত্যেকটি পরিবহনে ডাকাতিতে সে নিজে সশরীরে অংশগ্রহণ করে। ডাকাতির সময় সে পরিবহনে উঠে প্রথমে বাস স্টাফদের এবং যাত্রীদের মারধর করে ভীতির সঞ্চার করে। পরে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে এবং বাকীরা যাত্রীদের নিকট থেকে নগদ অর্থ, মোবাইল এবং স্বর্ণালঙ্কার লুট করে। তার নামে দেশের বিভিন্ন থানায় ডাকাতিসহ অস্ত্র আইনে মোট ০৭টি মামলা রয়েছে।
গ্রেফতার হাসান মোল্লা’কে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, সে উক্ত ডাকাত সর্দারের অন্যতম সহযোগী এবং দীর্ঘ ১০/১২ বছর যাবৎ ডাকাতি করে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে সে ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি বাস ডাকাতির পরিকল্পনাকারী ও বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে থাকে। ডাকাতির সময় সে পরিবহনে উঠে প্রথমে বাস স্টাফদের এবং যাত্রীদের মারধর করে ভীতির সঞ্চার করে। পরবর্তীতে তাদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রাখে। তার নামে দেশের বিভিন্ন থানায় ডাকাতিসহ অস্ত্র আইনে মোট ১০টি মামলা রয়েছে।
গ্রেফতারকৃত নুর ইসলাম, হানিফ, আরিফ, শরীফ ও রতন এই চক্রের অন্যতম সদস্য। তারা পেশায় যথাক্রমে অটোরিক্সা চালক ও পিকআপ ভ্যান চালকসহ অন্যান্য পেশার আড়ালে ডাকাতির সাথে সম্পৃক্ত। বিগত দশ বছর যাবত তারা বিভিন্ন স্থানে ডাকাতি করে আসছে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ডাকাতিতে তারা অংশগ্রহণ করে। ডাকাতির সময় তারা বাসের ড্রাইভারকে জিম্মি করে নিজেরাই বাসের ড্রাইভিং সিটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিত। গ্রেফতারকৃত আরিফ ও শরীফ ড্রাইভার এবং সুপারভাইজারকে অস্ত্রের মুখে গাড়ির পেছনের সীটে হাত-পা বেধে রেখে তাদের পাহারা দিত। গ্রেফতারকৃত শরীফ ৮/১০ বছর যাবত বিভিন্ন স্থানে ডাকাতি করে আসছে। তার নামে বিভিন্ন থানায় ডাকাতিসহ অন্যান্য অপরাধে ০৮টি মামলা রয়েছে।
গ্রেফতারকৃত আরিফ এর নমে দস্যুতার মামলা রয়েছে। গ্রেফতারকৃত নুর, হানিফ ও রতন ডাকাতির সময় অস্ত্রের মুখে যাত্রীদের মালামাল লুট করত। গ্রেফতারকৃত নুর এর নামে ডাকাতি, অস্ত্র, বিস্ফোরক আইনে বিভিন্ন থানায় ০৪টি মামলা রয়েছে। গ্রেফতারকৃত হানিফ এর নামে ডাকাতি ও মাদক আইনে ০২টি মামলা রয়েছে। গ্রেফতারকৃত রতন এর নামে ডাকাতি ও মাদক আইনে বিভিন্ন থানায় ০৫টি মামলা রয়েছে। ইতোপূর্বে তারা উক্ত মামলায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছিল।
গ্রেফতারকৃত রাজু ও রেজাউল এই চক্রের অন্যতম সদস্য। গ্রেফতারকৃত রাজু দীর্ঘ ১৬-১৭ বছর যাবত বিভিন্ন স্থানে ডাকাতি করে আসছে। তার নামে অস্ত্র ও ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে ০৩টি মামলা রয়েছে। সে ডাকাতির সময় অস্ত্রের মুখে যাত্রীদের মালামাল লুট করত। গ্রেফতারকৃত রেজাউল ডাকাতির সময় সে গাড়ির গেইটে পাহারা দিত। তার নামে মাদক, ডাকাতি, ছিনতাই ও অস্ত্র আইনে মোট ০৬টি মামলা রয়েছে। পরিবহনে ডাকাতির সময় তারা যাত্রীদের নিকট হতে টাকা, মোবাইল ফোন এবং স্বর্ণালঙ্কার লুটের কাজ করত। গ্রেফতারকৃত নজরুল সে ডাকাত দলটির লুটকৃত স্বর্ণ ক্রয় করে সেগুলো গলিয়ে বিভিন্ন জুয়েলারী শপে বিক্রি করত।