প্রকাশ: ২৪ মে, ২০২২ ০৫:২০ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক: জুয়া খেলতে গিয়ে নিজের মোবাইলটা খুয়ায়ে পরিবারের ভয়ে আত্মগোপনে চলে যায় সুমন নামের এক ব্যক্তি। দীর্ঘ ১২ বছর পর আত্মগোপনে থাকায় ওই ব্যক্তিকে উদ্ধার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এরমধ্যে এক মহিলাকে বিয়ে করে সংসার ও শুরু করেন এই ব্যক্তি। মেয়ের সাথে পরিচয়ের পরে, তার মায়ের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়ান সুমন। পরে ওই নারীকে বিয়ে করায় প্রয়োজন পড়েনি পরিবার সদস্যদের বলে জানিয়েছেন পিবিআই।
মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পিবিআই ঢাকা মেট্রো উত্তরের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার (এসপি) জাহাঙ্গীর আলম এসব তথ্য জানান।
এসপি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বার বছর আগে গত ২০১০ সালের ৩১ আগস্ট সকালে সুমন বাসা থেকে তার কর্মস্থল ডায়মন্ড প্যাকেজিং গার্মেন্টসে যাওয়ার পথে মিরপুর-১১ নম্বর বাজার এলাকায় রাস্তার মোড়ে ৩ তাসের জুয়া খেলায় ১০০ টাকা ধরে হেরে যায়। পরে তার কাছে টাকা না থাকায় জোর করে তার মোবাইল ফোন জুয়ারীরা রেখে দেয়। ভয়ে আত্মেগোপনে চলে যায় সুমন।
তিনি বলেন, সুমন কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে বের হয়ে আর বাসায় না ফেরা এবং ফোন করে না পাওয়ায়, তার বাবা মোজাফ্ফর তার ছেলের নিখোঁজের বিষয়ে ওই বছর ২০১০ সালের ৫ অক্টোবর পল্লবী থানায় একটি সাধারণ ডায়রী (জিডি) করেন। যা পল্লবী থানার জিডি নং—৩৬২।
পরে সুমনের বাবা মোজাফ্ফর জানতে পারে আসামী সুলায়মান হোসেন, শাওন পারভেজ, রুবেল, সোহাগ ও মানিক মিলে তার ছেলে সুমনকে অপহরণ করেছে। এরপর ওই বছর ২৯ অক্টোবর পল্লবী থানায় একটি অপহরণ মামলা দায়ের করে। যা পল্লবী থানার মামলা নং—৯০।

মামলা হাত বদল-
পল্লবী থানায় মামলা হওয়ার পরে থানা পুলিশ ভুক্তভোগীকে উদ্ধার ও আসামী গ্রেপ্তার করতে না পাড়লে ২০১০ সালের ৩০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশ তদন্তভার গ্রহণ করে। এছাড়া ভুক্তভোগীর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করাসহ মামলার এজাহারনামীয় আসামীদের গ্রেপ্তার করে। পরে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করেন। কিন্তু কোনো কুলকিনারা করতে পারে না ডিবি। পরে ২০১২ সালের ২৫ এপ্রিল মামলারটি তদন্তভার পায় সিআইডি। সিআইডি ভুক্তভোগীকে উদ্ধারের চেষ্টায় সারাদেশে বেতার বার্তা পাঠায়। তবে সিআইডিও ভুক্তভোগী উদ্ধারসহ মামলার কোনো শেষ করতে পারে না।
এক বছর পরে এজাহারনামীয় আসামীদের বিরুদ্ধে অপহণের অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ২০১৩ সালে ১ এপ্রিল আতদালতে চার্চসীট দেন। সিআইডি চার্চসীট সুমনের পিতার না—রাজীর আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত ফের মামলাটি তদন্তের জন্য ডিবিতে পাঠায়।
এবারও ডিবির কয়েকজন তদন্ত তদন্ত কর্মকর্তার হাত বদলেও কোনো আশার আলো দেখা যায় না। তবে একটু কুলু পায় তারা ভুক্তভোগীর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি আসামী সুলায়মান এডিসি ক্যাম্পের কাঁচা বাজারের জুয়ার বোর্ড থেকে ক্রয় করেন। এতেই সন্তুষ্ঠ হয়ে ওই তদন্ত কর্মকর্তা ২০১৯ সালে ২৬ এপ্রিল আদালতে মামলার চার্চসীট জমা দেন। এবারও বাদীর না—রাজীর প্রেক্ষিতে আদালত মামলাটির তদন্তের জন্য পিবিআইতে পাঠায়।
পিবিআই হাল ছেড়ে দিয়ে আবার ধরে-
পিবিআই গত ২০১৯ সালের ৩ সেপ্টম্বর মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ নেন। তদন্তের একপযার্য়ে পিবিআই জানতে পারে, সুমন নিখোঁজ হওয়ার ১১ দিন পর সন্ধ্যা একটি কল আসে। কিন্তু অবস্থান জানতে চাইলে কোন উত্তর না দিয়েই ফোনের সংযোগটি বিচ্ছিন করে দেওয়া হয়। এরপর থেকে ওই মোবাইল নম্বরটি বন্ধ ছিল।
ওই ফোন কলের সূত্র ধরে পিবিআই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে সেনিটারী ইন্সপেক্টর আব্দুল হাইকে সনাক্ত করেন। তাকে ওই বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি জানান, মোবাইল সিমটি তার নামে থাকলেও তিনি ব্যবহার করতেন না। তার দুঃসম্পর্কের ভাগ্নে সালাউদ্দিনকে দিয়ে তিনি ওই মোবাইল সিমের মাধ্যমে শাহবাগ থানার সামনে ফ্লেক্সিলোডের দোকান করাতেন। পরে ভাগ্নে সালাউদ্দিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, অনেক অপরিচিত লোকজন ২ টাকা মিনিটে কথা বলতো। তবে কে কল করেছিল তা তিনি সনাক্ত করতে পারেনি। এক প্রকার হতাশ হয়ে পিবিআই চলতি বছরের ৯ মার্চ এই বলে মামলার চার্চসীট দালিখ করেন যে, তদন্তকালে প্রাপ্ত তথ্যাদি পর্যালোচনায় উপযুক্ত ও প্রয়োজনীয় তথ্য প্রমাণের অভাবে ভুক্তভোগীর অবস্থান সনাক্তসহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে ভবিষ্যতে ভুক্তভোগী উদ্ধার সংক্রান্তে কোন তথ্য পাওয়া গেলে মামলাটি পূনরুজ্জীবিত করা হবে বলে আদালতকে জানান হয়।
কিন্তু অল্প দিনেই পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলমের কাছে ওই ভুক্তভোগীর সম্পর্কে তথ্য আসলে চলতি মাসের ২৩ মে আদালতে মামলাটি পূনরুজ্জীবিত করার আবেদন করেন। আদালতের নির্দেশে আবার মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে পিবিআই ঢাকা মেট্রো উত্তরের একটি বিশেষ টিম তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় ভুক্তভোগী সুমনকে সনাক্ত করে। পরে গতকাল সন্ধ্যা রাজধানীর কদমতলী থানাধীন মদিনাবাগ এলাকা থেকে উদ্ধার করে।

সুমনের জীবনের নাটকীয়তা-
ভুক্তভোগী সুমনকে জিজ্ঞাসাবাদে পিবিআই জানতে পারে, সে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। পরে পরিবারের হাল ধরতে ডায়মন্ড প্যাকেজিং এ হেলপার হিসাবে কার্ম জীবন শুরু করে। ঘটনার দিন মিরপুর—১১ নম্বর বাজার এলাকার চার রাস্তার মোড়ে ৩ তাসের জুয়া খেলায় ১০০ টাকা ধরে হেরে যায়। তার কাছে টাকা না থাকায় তার কাছে থেকে জোর করে মোবাইল ফোন নিয়ে নেয় জুয়ারীরা।
বাবার কাছে বলবেন ওই ভয়ে কর্মস্থলে না গিয়ে সে মিরপুর থেকে গুলিস্থানে চলে যায়। সারাদিন গুলিস্থানে ঘোরাফেরা করে। রাতেও বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরা করে। পরদিন সকালে বায়তুল মোকাররম মসজিদে শুয়ে থাকে।
সেখান থেকে এক লোক তাকে শাহবাগ ফুল মার্কেটে নিয়ে নাস্তা খাওয়ায়। পরবতীর্তে টিপু নামে এক লোক তাকে শাহবাগ এলাকার একটি হোটেলে শুধু থাকা ও খাওয়ার শর্তে কাজ দেয়। ঐ হোটেলের বাবুর্চি হারুনের সাথে তার বন্ধুত্ব হয় এবং তার সাথে সুমন ভোলার লালমোহন থানাধীন মঙ্গল শিকদার এলাকায় একাধিক বার যায়।
এরপর শাহবাগ এলাকায় বিভিন্ন চটপটির দোকানে কাজ, পপকর্ণ বিক্রি, বাসের হেলপার, রুমা এ্যকুরিয়াম সেন্টার, পপুলার এ্যকুরিয়াম সেন্টারসহ বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে। এরই মধ্যে নান্নু ওস্তাদ নামে এক ড্রাইভারের সাথে তার পরিচয় হয়। তার সাথে হেলপারি শুরু করে। ইউসুফ টেকনিক্যাল স্কুল ও বারডেম হাসপাতালের যাত্রী আনা নেওয়া করত। ইউসুফ স্কুলের জোনাকী নামের একটি মেয়ের সাথে তার ভাল সম্পর্ক ছিল। সেই সুবাদে তাদের বাসায় যাওয়া আসা ছিল সুমনের। এর একপযার্য়ে জোনাকীর মা জোসনার সাথে তার প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পরে ভুক্তভোগী।
জোসনার স্বামী তাকে ডিভোর্স দিলে সুমন গত তিন বছর পূর্বে লালবাগ কাজী অফিসে জোসনাকে বিয়ে করে। এরমধ্যে তার একটি ছেলে হয়, নাম—হাবিবুল্লাহ। পরে ভুক্তভোগী উদ্ধারের পূর্ব পর্যন্ত সুমন তার স্ত্রী জোসনার সাথেই রায়েরবাগ এলাকার বিভিন্ন স্থানে বসবাস করে আসছিল বলে জানা গেছে।