প্রকাশ: ১৫ মার্চ, ২০২২ ০৮:২৯ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক: আগামী ২৬ মার্চ কেন্দ্র করে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করার জন্য সাভার রাজাসন মন্ডল পাড়া রফিক সাহেবের বাড়ির ২য় তলায় নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন আনসার আল ইসলামের কয়েকজন সক্রিয় সদস্যকে নিয়ে গোপন বৈঠক করার সময় গ্রেপ্তার হয়েছে জঙ্গি সংগঠক মুন্সি ইকবাল।
মুন্সি ইকবাল আনসার আল ইসলামের সংগঠক। তিনি আলোচিত আরেক জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজিবি) প্রধান মুফতি হান্নানের ছোট ভাই। তারা এই স্বাধীনতার মাসেও গোপনে বৈঠক করে নাশকতা করার পরিকল্পনা করেছিল বলে জানিয়েছে র্যাব।
র্যাবের ভাষ্য, এই জঙ্গি সংগঠক গোপনে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য দেশে ও দেশের বাইরে (আফগানিস্তান) পলাতক থেকে প্রশিক্ষণসহ নতুন নতুন কৌশল রপ্ত করেন। পরে নতুন করে আবার জঙ্গি তৎপরতা শুরু করতে যাচ্ছে বলে খবর আসে।
গত শুক্রবার রাতে সাভার থেকে গ্রেফতার হয় মুফতি হান্নানের ছোট ভাই মুন্সী ইকবাল। যার নামে চারটি মামলা রয়েছে। এ ছাড়া সাভার মডেল থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে আরও একটি মামলা হয়েছে।
সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী মাইনুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, গতকাল র্যাব বাদী হয়ে মামলা করে জঙ্গি নেতা মুন্সী ইকবালকে থানায় হস্তান্তর করেছে। গত রোববার আদালতে তুলে সাত দিনের রিমান্ডি আবেদন করা হয়। তবে আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেছে।
মুন্সী ইকবালের আরও দুই সহযোগী গ্রেপ্তার
আনসার আল ইসলামের সংগঠক মুন্সী ইকবাল গ্রেপ্তার হওয়ার দুই দিন পরেই
গত ১৩ মার্চ রাতে রাজধানীর শাহআলী থানাও মিরপুর মডেল থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে মামলার মুন্সী ইকবালসহ এজাহার ভুক্ত দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। তাদের কাছ থেকেও উগ্রবাদী বই, লিফলেট ও মোবাইল জব্দ করা হয়েছে।
র্যাব-৪ এর উপ-পরিচালক পুলিশ সুপার (এসপি) জয়িতা শিল্পী বলেন, 'আনসার আল ইসলামের অন্যতম সংগঠক মুন্সি ইকবাল আহমেদের দুই সহযোগী মোশাররফ হোসেন (৪৫) ও আসমা খাতুন (৪২) এজাহার ভুক্ত আাসামী ছিলেন। ইকবালের দেওয়া তথ্য ধরে তদেরও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এসপি জয়িতা শিল্পী ঢাকাটাইমসকে জানান, তারা নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হরকাতুল জিহাদের সদস্য ছিল বলে জানা গেছে। এছাড়া সংগঠনের অন্যান্য ৫-৬ জন সদস্যদের নিয়ে ১১ মার্চ রাতে সংগঠনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বৈঠকে মিলিত হয়েছিল তারা।
তিনি বলেন, “আনসার আল ইসলাম”এর সংগঠক হিসেবে অন্যান্য সদস্যদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করে আসছিলো তারা। বিজয় দিবসের আগে অরাজকতা সৃষ্টি করতে তার মিলিত হয়। পরে তাদের আগের মামলায় সাভার থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।
যেইভাবে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে পরিবারটি-
গোপালগঞ্জের কোটয়ালীপাড়ার হীরন গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন হান্নান। পরে প্রথমিক পাঠ নেন স্থানীয় একটি মাদ্রাসায়। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য ১৯৮৭ সালে পাকিস্তানের করাচির নিউ টাউন মাদ্রাসায় ভর্তি হন তিনি। ওখানেই পড়ার সময় মূলত জঙ্গিবাদের জড়িয়ে পড়েন আব্দুল হান্নান। বাংলাদেশে মূলত জঙ্গিবাদের উর্থান হয় হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের (হুজবি) নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানের হাত ধরেই।
হাইকোর্টে বিচার চলার সময় দেওয়া মুফতি হান্নানের জবানবন্দি থেকে জানা যায়, ১৯৮৮ সালে তিনি পাকিস্তান ও আফগানিস্তান সীমান্তে রণাঙ্গনে যুদ্ধে অংশ নেন। এ সময় আহতও হন তিনি। বাংলাদেশে ফিরে ১৯৯৪ সালে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশে যোগ দেন। প্রথম পর্যায়ে তিনি কোটলীপাড়া থানার প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু তার সাংগঠনিক দক্ষতা ও দুধর্ষতার সুবাদে দ্রুতই কেন্দ্রীয় নেতা হয়ে ওঠেন।
পরিবারের দশ ভাই-বোনের মধ্যে তারা পাঁচ ভাই, আর পাঁচ বোন। এদরে মধ্যে বড় ভাই আলীউজ্জামান, আর মুফতি হান্নান দ্বিতীয়। এছাড়া গতকাল শনিবার র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয় তাদের তৃতীয় ভাই মুন্সী ইকবাল। এদের মধ্যে জঙ্গিবাদের সংশ্লিষ্ট থাকায় দুই ভাইয়ের মৃত্যদণ্ডের আদেশ রয়েছে। মুফতি হান্নানের স্ত্রী জাকিয়া পারভিন রুমা, তার বড় মেয়ে নিশি খানম ও ছোট মেয়ে নাজরিন খানম।
ওই সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও মুফতি হান্নানকে দুধর্ষ জঙ্গি নেতা হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। এই জঙ্গি নেতা হান্নানের বিশেষত্ব হল তিনি সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এছাড়া নিজেই বিভিন্ন জঙ্গি হামলার প্রশিক্ষণ ও পরিকল্পনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকেছেন। এছাড়া তার বিশেষত্ব তিনি আফগান স্টাইলে বাংলাদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার তৎপরতা চালিয়ে আসছিলনে। প্রথমে দেশী বোমা ব্যবহার করলেও পরে পাকিস্তান থেকে গ্রেনেড সংগ্রহ করতে থাকেন এই নেতা। এ ছাড়া বোমা বানানো ও আক্রমণের বিষয়েও তার সামরিক প্রশিক্ষণ আছে, প্রশিক্ষণও দিতেন তিনি।
দেশে জঙ্গিবাদ শুরু যেখান থেকে-
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের শুরুটা হয়েছিল হরকাতুল জিহাদের আক্রমণের মধ্য দিয়েই। বাংলাদেশে বড় জঙ্গি হামলার অনেকগুলোই হয়েছে মুফতি আব্দুল হান্নানের নেতৃত্বে ও পরিকল্পনায়। হরকাতুল জিহাদই প্রথম বাংলাদেশে জঙ্গি হামলা শুরু করে। ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচির অনুষ্ঠানে বোমা হামলার মাধ্যমে। সেই ঘটনার পরিকল্পনায় ও নেতৃত্বে মুফতি হান্নান নিজে ছিলেন। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যতগুলো জঙ্গি হামলা হয়েছে। এছাড়া তার নেতৃত্বে সবচেয়ে বেশি হামলা হয়েছে।
একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, মুফতি হান্নানের নেতৃত্বে ও পরিকল্পনায় সাত বছরে ১৩টি জঙ্গি হামলা হয়েছে। এসব ঘটনায় ১০১ জন মানুষ নিহত হন। আর আহত হন ৬০০ জনেরও বেশি মানুষ। হান্নানের বিরুদ্ধে মোট ১৭ মামলা ছিল। এর মধ্যে দুটিতে তার মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়।
গত ২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটের হযরত শাহজালালের (রা.) মাজারে আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা হয় তার নেতৃত্বে। ওই হামলায় আনোয়ার চৌধুরী, সিলেটের জেলা প্রশাসকসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত ও পুলিশের দুই কর্মকর্তাসহ তিনজন নিহত হন। ওই মামলায় ২০০৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিচারিক আদালত ৫ আসামির মধ্যে মুফতি হান্নান, শরীফ শাহেদুল বিপুল ও দেলোয়ার হোসেন রিপনকে মৃত্যুদণ্ড এবং মহিবুল্লাহ ও আবু জান্দালকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে মুফতি হান্নানের রিভিউ আবেদন খারিজ করে আগের রায় বহাল রাখেন। পরে গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে মুফতি হান্নানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।