ঢাকা, রবিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩ চৈত্র ১৪৩২, ১৬ জ্বমাদিউল সানি ১৪৪৭

টাকার বিনিময়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি মুক্ত পাখি


প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারী, ২০২২ ০৮:৩০ পূর্বাহ্ন


টাকার বিনিময়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি মুক্ত পাখি

* টাকায় কিনা পরে, একজনের সাঁজা খাটছে আরেকজন
* টাকার বিনিময় একজনের সাঁজা খাটছে আরেকজন
* পাঁচ হাজার টাকার চুক্তিতে আসামি বদল
* নিজেকে বাঁচতে দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা ছিল সোহাগের
* মামাকে বাবা বানিয়ে এনআইডি কার্ড, তাতেই পাসপোর্ট-ভিসা
* করোনা পরিস্থিতির কারণে আটকে গেল সোহাগ

নিজস্ব প্রতিবেদক: তাহার শুরু ২০১০ সালের ২৬ নভেম্বর কদমতলী দিন-দুপুরে পূর্বপরিকল্পিত ভাবে হ‌ুমায়ূন কবিরকে হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। র‍্যাব বলছে ওই হত্যাকাণ্ড দিয়ে তার হাতে খড়ি। পরে একে একে বড় সোহাগের নামে ২টি হত্যা মামলা,২টি অস্ত্র মামলা ও ৬টি মাদক মামলা রয়েছে। তবে প্রথম হত্যা মামলায় সোহাগের যাবজ্জীবন সাজা হয়। পরে সাজা ভোগের জন্য আয়নাবাজি সিনেমার মত অন্যকে আসামি সাজিয়ে আদলতে হাজির করেন সোহাগ। 

গত শনিবার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল মিটফোর্ড হাসপাতালে করোনার দ্বিতীয় ডোজ টিকা নিতে আসলে যাবজ্জীবন সশ্রম সাজাপ্রাপ্ত আসামি বড় সোহাগকে গ্রেপ্তার করেছেন র‍্যাব-১০।

রোববার রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‍্যাব মিডিয়া সেন্টার আয়োজন সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাব-১০ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মাহফুজুর রহমান বলেন, সোহাগ (৩৪) ওই বছরই গ্রেপ্তার হয়। পরে ২০১৪ সালের মে মাসে জামিনে মুক্তি পায়। এর পর থেকেই পলাতক আছে। কিন্তু অপরাধ থেমে নেই তার। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে আসামি সোহাগের অনুপস্থিতিতে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন আদালত। 
 
অতিরিক্ত ডিআইজি মাহফুজুর রহমান বলেন, ওই রায় ঘোষণার তিন দিন পর, ২০১৮ সালের পয়লা জানুয়ারি সোহাগের পরিকল্পনা মতে ফুফাতো ভাই হোসেন (৩৫ (নকল সোহাগ) আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেন। পরে আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাকে জেল হাজতে পাঠিয়ে দেন। সে সময় মাদকাসক্ত হোসেন প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে জেলহাজতে যেতে রাজি হয়। এ ছাড়া ২ থেকে ৩ মাসের মধ্যে বের করে আনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। 

তিনি বলেন, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি সোহাগ নিজেকে বাঁচাতে দেশ থেকে পালানোর উদ্দেশ্যে ‘আয়নাবাজি’সিনেমার কাহিনির মতো অন্যজনকে আসামি হিসেবে আদালতে পাঠান। আদালতও হোসেনকে ‘সোহাগ ভেবে’জামিন না মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠান। হোসেনের বাবার নাম মৃত হাসান উদ্দিন। আর আসল সোহাগের বাবার নাম গিয়াস উদ্দিন। এ ছাড়া চেহারাই অমিল, উচ্চতাইও অমিল থাকা সত্ত্বেও আসামি বদল বুঝতে পারে না আদালত। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত কারাগারে আছেন নকল সোহাগ। আর আসল সোহাগ চলে যান আইনের আড়ালে। অন্যদিকে আসল আসামি সোহাগ দেশ থেকে পালিয়ে দুবাই যাওয়ার উদ্দেশ্যে নতুন করে প্রতারণার আশ্রয় নেন। এ ছাড়া পিতার নাম পরিবর্তন করে বাগিয়ে নেয় এনআইডি কার্ড ও পাসপোর্ট। 

অধিনায়ক মাহফুজুর রহমান বলেন, গত ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে জনৈক সাংবাদিক উল্লিখিত টিটু হত্যা মামলায় একজনের পরিবর্তে অন্যজন জেলা খাটার বিষয়টি আদালতের নজরে নিয়ে আসেন। পরে আদালত কারা কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন চায়। প্রতিবেদনে ২০১০ সালে গ্রেপ্তার আসামি সোহাগ আর বর্তমানে হাজতে থাকা নকল সোহাগের অমিলের বিষয়টি উঠে আসে। পরে সংশ্লিষ্ট থানা-পুলিশের রিপোর্টে বিষয়টির সত্যতা মিলে যায়। এ ছাড়া গত বছরের আগস্ট মাস থেকে কাজ করে আসছে র‍্যাব। এরই মধ্যে বিশেষ দায়রা আদালত ও দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪, প্রকৃত আসামীর (সোহাগ) বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে র‍্যাব-১০ অধিনায়ক বরাবর অনুলিপি পাঠায়। 

তিনি বলেন, তবে প্রকৃত সোহাগ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বুঝতে পারেন। পরে গ্রেপ্তার এড়াতে কৌশলে দেশত্যাগের চেষ্টা শুরু করে। সবকিছু জোগাড়ও হয়ে যায় তার। খুব সহজে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) কার্ড সংশোধন করে বাবার নাম গিয়াস উদ্দিন ওরফে কাঙ্গালের জায়গায় মামা শাহআলমের নাম অন্তর্ভুক্ত করেন। পরে দশ হাজার টাকায় করেন পাসপোর্ট। আর ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে মামাতো ভাইয়ের মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভিসা সংগ্রহ করেন সোহাগ। দেশত্যাগের ক্ষেত্রে করোনার টিকা বাধ্যতামূলক হওয়ায় গতকাল করোনার ২য় ডোজ টিকা করতে মিটফোর্ড হাসপাতালে এসে গ্রেপ্তার হন। 

এক প্রশ্নের জবাবে র‍্যাব-১০ এর অধিনায়ক মাহফুজুর রহমান বলেন, মামলার বিবরণ অনুযায়ী আসল সোহাগ অটোচালক হলেও সে মূলত পেশাদার অপরাধী। ২০১০ সালে হত্যাকাণ্ডের পরে সে বেশ কিছুদিন সোহাগ কদমতলী থেকে মাওয়া রোডে বাসের হেলপারি করেছেন। সোহাগের নামে ১০টি মামলা রয়েছে। আর প্রতারণার জন্য রাজধানীর ডেমরা থানায় আরও একটি মামলা হয়েছে। 

এনআইডির তথ্য সংশোধন ও পাসপোর্ট হাতিয়ে নেওয়ার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে র‍্যাব-১০ অধিনায়ক বলেন, র‍্যাব আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আসল অপরাধীকে গ্রেপ্তার করেছে। এখন ওই মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তা বিষয়টি দেখভাল করবেন, জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। তবে র‍্যাব সদর দপ্তর যদি মনে করেন এ চাঞ্চল্যকর মামলাটি র‍্যাবের তদন্তাধীন বিষয়, তাহলে আবেদন করে মামলার তদন্তভার নেওয়া হবে। 

কীভাবে আসল সোহাগের পরিবর্তে নকল সোহাগ আদালতে জামিন চাইলেন ও কারাগারে গেলেন, এসবের পেছনে তদন্তকারী কর্মকর্তা ও আইনজীবীর দায় খোঁজা হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আদালতে আসামি বদলে ফেলার বিষয়টি ধরতে পারা কঠিন বিষয়। তবে এ ক্ষেত্রে কারাগার অবশ্যই পারে। কারণ তাদের কাছে ডেটাবেইস আছে ও আসামি শনাক্তকরণের বিবরণীও সংরক্ষিত আছে। তবে এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আসামির আইনজীবী জেনেই নকল সোহাগের জামিন চেয়ে আদালতে আবেদন করেছিলেন। তার দায় তদন্তকারী কর্মকর্তা নিশ্চয় খুঁজবেন।


   আরও সংবাদ