প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারী, ২০২২ ০৪:৫০ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক: হেলাল হোসেন ওরফে সেলিম ফকির। মাথায় চুল নেই, মুখ ভর্তি দাঁড়ি, গলায় পুথির মালা আর পরনে বাউলদের মতো সাদা চাঁদর। এই চাঁদরেই ডেকে আছে তিনটি হত্যা মামলাসহ পাঁচটি মামলার প্রকৃত আসামি। তার মধ্যে আলোচিত বগুড়ার বিদ্যুৎ হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ফেরারি আসামি তিনি।' ভাঙ্গা তরী ছেঁড়া পাল' গানের দুটি দৃশ্যে দেখা গেছে তার। তবে পুরো পাকার অভিনয় শিল্পীর তম হেঁটে গেছেন তিনি। বাউল গানের মডেলও একেবারে খারাপ না।
একাধিক হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধের পর আত্মগোপনে যাওয়া ছদ্মবেশী বাউল ও বাউল গানের মডেল হেলাল হোসেন ওরফে সেলিম ফকিরকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। কণ্ঠশিল্পী পলাশের 'ভাঙ্গা তরী ছেঁড়া পাল' গানের বাউল মডেল হিসেবে অভিনয় করে পাঁচ বছর আগে। দীর্ঘদিন পর সেই ভিডিও দেখে পরিচয় নিশ্চিত হয় স্থানীয়রা। এরপর এই বাউলের বিষয়ে র্যাবকে জানাই তারা। ছয় মাস ধরে র্যাবের গোয়েন্দারা তার অবস্থান শনাক্ত করতে কাজ করে। পরে গতকাল রাতে কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলস্টেশন এলাকা থেকে হেলালকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-৩।
আজ বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টায় রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এতথ্য জানান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন র্যাব-৩ এর উপ-অধিনায়ক মেজর রাহাত হারুন খান ও মিডিয়া অফিসার এএসপি ফারজানা হক।

র্যাবের দাবি, হেলালের বিরুদ্ধে তিনটি হত্যা মামলাসহ আরও দুটি মামলা আছে। বগুড়ার বিদ্যুৎ হত্যা মামলায় তার যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। মূলত এই সাজা এড়াতেই ছদ্মবেশ ধারণ করে বাউল বেশে ঘুরতে থাকে হেলাল।
বগুড়ায় তার যত অপরাধ-
১৯৯৭ সালে প্রথম বগুড়াতে চাঞ্চল্যকর বিষ্ণু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তার হাতে খড়ি। ওই মামলায় ২১ বছর বয়সে হত্যা মামলার এজাহারনামীয় আসামি ছিল। ২০০০ সালে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এলাকায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে প্রতিপক্ষের ধারালো দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে তার বাম হাত পঙ্গু হয়। ২০০১ সালে ফের এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মাহমুদুল হাসান বিদ্যুৎকে কুপিয়ে হত্যা করে। ২০০৬ সালে রবিউল নামের আরও হত্যা করে। পরে ২০১০ সালে একটি চুরির মামলায় ২০১৫ সালে গ্রেপ্তার হয়। এছাড়াও, ২০১১ সালে তার বিরুদ্ধে বগুড়া সদর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা রয়েছে।
তরুণ বয়স থেকেই অপরাধের শুরু তার-
২০০১ সালের বগুড়ার চাঞ্চল্যকর বিদ্যুৎ হত্যা মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত সেলিম। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে আরও দুইটি হত্যা মামলা রয়েছে। যার একটি ১৯৯৭ সালে বগুড়ার বিষ্ণু হত্যা মামলা এবং ২০০৬ সালে রবিউল হত্যা মামলা রয়েছে। চাঞ্চল্যকর বিষ্ণু হত্যা মামলায় হেলাল ২১ বছর বয়সে এজাহারনামীয় আসামি ছিলেন। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছিল। এলাকায় বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে দুর্ধর্ষ হেলাল নামে পরিচিতি পায়। এ ছাড়া ২০১০ সালে বগুড়া সদর থানায় একটি চুরির মামলায় ২০১৫ সালে গ্রেপ্তার হন হেলাল ওরফে বাউল হেলাল। তা ছাড়া নারী নির্যাতন আইনেও তার বিরুদ্ধে একটি মামলা রয়েছে।
প্রতিপক্ষের হামলায় হাত হারান-
২০০০ সালে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বগুড়ায় দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়। প্রতিপক্ষের ধারালো দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে তার বাম হাতে মারাত্মক জখম হয় এবং বাম হাত পঙ্গু হয়। এই ঘটনার পর সে লুলা হেলাল নামে পরিচিতি পায়।
যেভাবে ফেরারি জীবনে হেলাল-
৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে পরবর্তীতে মুদি দোকানি শুরু করেন র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হেলাল। একসময় মুদি দোকানি থাকলেও পরবর্তীতে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। পরে গ্রেপ্তার এড়াতে ছদ্মবেশে বিভিন্ন মাজার ও রেলস্টেশনে ভবঘুরে হয়ে চলতে শুরু করেন। চেহারা যাতে কেউ না চিনতে পারেন সে জন্য রাখেন বড় দাঁড়ি ও চুল। একটি বাউল গানের শুটিংয়ের সময় তাকে মডেল হিসেবে অভিনয় করানো হয়। সেই গানের ভিডিও দেখে স্থানীয়রা শনাক্ত করেন বাউল ছদ্মবেশী হেলাল ফকির একজন নীরব কিলার। তার বিরুদ্ধে ২০১০ সালে চুরির মামলা এবং ২০১৫ সালে জামিন পাওয়ার দিনে বিদ্যুৎ হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজা হলে কৌশলে এলাকা ত্যাগ করেন।
এরপর ফেরারি জীবন যাপন শুরু করেন। প্রথমে সে বগুড়া থেকে ট্রেনে ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনে আসে। পরবর্তীতে কমলাপুর থেকে ট্রেনে চট্টগ্রামে চলে যান। সেখানে আমানত শাহ মাজারে ছদ্মবেশ ধারণ করে বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন। পরে ট্রেনে সিলেটের শাহজালাল মাজারে চলে যান। সেখানে ছদ্মবেশ ধারণ করে আরও কিছুদিন অবস্থান করেন। এভাবে সে বিভিন্ন রেলস্টেশন ও মাজারে ছদ্মবেশে অবস্থান করে। কিশোরগঞ্জ ভৈরব রেলস্টেশনে নাম-ঠিকানা ও পরিচয় গোপন রেখে সেলিম ফকির নাম ধারণ করে। ৫ বছর আগে হেলাল নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনে কিশোর পলাশ ওরফে গামছা পলাশের একটি গানের শুটিং চলাকালে রেললাইনের পাশে বাউল গান গাচ্ছিল। তখন শুটিংয়ের একজন ব্যক্তি তাকে গানের মিউজিক ভিডিওতে অভিনয়ের প্রস্তাব দিলে বহুল জনপ্রিয় 'ভাঙ্গা তরী ছেঁড়া পাল' শিরোনামের গানের বাউল মডেল হিসেবে তাকে দেখা যায়।
চার বছর ভৈরব স্টেশনে-
গত প্রায় ৭ বছর দেশের বিভিন্ন জায়গায় ফেরারি জীবন যাপন করার পর সবশেষ চার বছর কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলস্টেশনের পাশে একজন মহিলার সঙ্গে সংসার শুরু করেন। রেলস্টেশনে বাউল গান করে মানুষের কাছ থেকে জীবিকা নির্বাহ করত।