ঢাকা, রবিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩ চৈত্র ১৪৩২, ১৬ জ্বমাদিউল সানি ১৪৪৭

বন্ধুত্বের সম্পর্কের একপর্যায়ের দামি উপহারে সর্বনাশ


প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারী, ২০২২ ০৩:১৯ পূর্বাহ্ন


বন্ধুত্বের সম্পর্কের একপর্যায়ের দামি উপহারে সর্বনাশ

নিজস্ব প্রতিবেদক: প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা, পরে ছোট ছোট উপহার দেওয়া-নেওয়া। একপর্যায়ে বলা হয় তার নামে বিমানবন্দরে দামি পার্সেল পাঠানো হয়েছে। ডেলিভারির জন্য কাস্টমস চার্জ হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকা মোবাইল  ব্যাংকিং বিকাশে পরিশোধ করতে বলা হয়। দামি উপহারের প্রলোভনে টাকা পাঠিয়ে বিমানবন্দরে গিয়ে গেলে দেখা যায়, কোন পার্সেল আসেনি। যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও আর পাওয়া যায় না বন্ধুকে। এভাবেই দিনের পর দিন দেশীয়দের সহায়তায় প্রতারণা করে আসছিল বিদেশি একটি চক্র। 

গতকাল মঙ্গলবার রাতে ও বুধবার সকালে রাজধানীর পল্লবী, রূপনগর ও দক্ষিণখান এলাকায় অভিযান চালিয়ে অভিনব কায়দায় প্রতারণার অভিযোগে দুই জন বাংলাদেশিসহ ছয়জন নাইজেরিয়ান ও একজন দক্ষিণ আফ্রিকান নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব-৪। 

বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারের র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‍্যাব-৪ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক।

সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের ৬ নাইজেরিয়ান হলেন, উদিজ ওবিন্না রুবেন (৪২), ইফুনান্যা ভিভিয়ান নাউকি (৩১), সানডে শেডারেক ইজিম (৩২), চিনেদু মোসেস নাজি (৩৬), কলিমস ইফেসিনাচি টালাইক (৩০) ও চিদিম্মা ইবেল আইলোফর (৩৬)। গ্রেপ্তার দক্ষিণ আফ্রিকান নাগরিকের নাম টম্বিখনা গেবুজা (৩৬)। এ ছাড়াও এই চক্রের সঙ্গে জড়িত দুই বাংলাদেশী হলেন, নাহিদুল ইসলাম (৩০) ও সোনিয়া আক্তার (৩৩)। তাদের কাছ থেকে ৮টি পাসপোর্ট, ৩১টি মোবাইল, ৩টি ল্যাপটপ, একটি চেক বই, ৩টি পেনড্রাইভ ও নগদ ৯৫ হাজার ৮১৫ টাকা জব্দ করা হয়। 

মোজাম্মেল হক বলেন, ‘তারা সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া আইডি খুলে নিজেদের পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশের নাগরিক বলে পরিচয় দেয়। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির পর দামি উপহার বাংলাদেশে পাঠানোর কথা বলে। এর কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশের কাস্টমস অফিসার পরিচয়ে এক নারী ফোন করে বলে তার নামে বিমানবন্দরে একটি পার্সেল এসেছে। পার্সেলটি ডেলিভারি করতে কাস্টমস চার্জ হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকা বিকাশ বা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বরে পরিশোধ করতে বলা হয়। যেহেতু পার্সেলে মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী রয়েছে তাই কাস্টমস চার্জ একটু বেশি হয়েছে বলে তাদের বোঝানো হয়। অর্থ পরিশোধ করার পর পার্সেলটি নিতে বিমানবন্দরে গেলে দেখা যায় তার নামে কোন পার্সেল আসেনি। বিদেশি বন্ধুরও তখন আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় না।’ 

প্রতারণার কৌশল সম্পর্কে র‍্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘বড় বড় ব্যবসায়ী, হাই প্রোফাইল চাকরিজীবী উচ্চবিত্ত মানুষদের ভিকটিম এরা প্রথমে টার্গেট করে। টার্গেট করার পর নিজেদের বিভিন্ন উন্নত দেশের সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে টার্গেটের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে। বিশ্বাস স্থাপনের জন্য ভুয়া ছবি পাঠায়।’ জনসেবামূলক কাজে অর্থ ব্যয় করে চাকরিজীবীদের কমিশন প্রদান এবং ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করার কথা বলেও প্রতারণা করে এই চক্রের সদস্যরা। 

মোজাম্মেল হক বলেন, ‘পার্সেল পাঠানোর পর চক্রের বাংলাদেশি নারী সহযোগী বিমানবন্দর কাস্টমস অফিসার পার্সেলটি ডেলিভারি করতে কাস্টমস চার্জ হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকা বিকাশ বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে বলেন। বলা হয়, বিদেশ থেকে কোন পার্সেল দেশে আনা আইনসিদ্ধ নয় তাই চার্জ একটু বেশি দিতে হবে। নকল টিন সার্টিফিকেট ও অন্যান্য কাগজ বানাতে অনেক অর্থের প্রয়োজন হবে। কেউ টাকা না দিতে চাইলে তাদের মামলার ভয়ভীতি দেখানো হতো।’ 

মোজাম্মেল হক আরও জানান, গ্রেপ্তার উদিজ ওবিন্না রুবেন ২০১৭ সালে ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসেন এবং ২০২০ সালে তার নামে প্রতারণার মামলা হওয়ায় তার পাসপোর্ট জব্দ করা হয়। সে নিজেকে একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দেয়। তিনি বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে প্রতারণাই তার মূল পেশা। সে এই আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের মূল হোতা। দক্ষিণ আফ্রিকান নাগরিক টম্বিখনা গেবুজা ২০২০ সালে ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসেন এবং সে নিজেকে রুবেনের স্ত্রী বলে পরিচয় দেয়।’ এ ছাড়াও সবারই ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে বলে জানান র‍্যাবের এই কর্মকর্তা। গ্রেপ্তারদের মধ্যে ২ জনের পূর্বের মামলা রয়েছে বলেও জানান তিনি। 

নাহিদুল ও সোনিয়া সম্পর্কে মোজাম্মেল হক বলেন, ‘সোনিয়া আক্তার ও নাহিদুল ইসলাম এই আন্তর্জাতিক চক্রের দেশীয় সহযোগী। নাহিদুল ২০১০ সালে একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে কাজ শুরু করে। পরবর্তীতে রেস্টুরেন্ট ও একটি কল সেন্টারে কাজ করে। ২০১৭ সালে ফ্যাশন ডিজাইন বিষয়ে ডিপ্লোমা করে ২০১৮ সালে মালয়েশিয়ায় যান। 

পরবর্তীতে ২০২১ সালে দেশে ফিরে আসেন এবং গ্রেপ্তার সোনিয়া আক্তারকে বিয়ে করেন। সোনিয়ার ২০০৯ সালে প্রথম বিবাহ হয় কিন্তু স্বামী নেশাগ্রস্ত হওয়ায় ২০১৭ সালে তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। ২০১৮ সালের শেষের দিকে নাইজেরিয়ান নাগরিক রুবেনের সঙ্গে পরিচয় হয়। তারপর থেকেই সে এই প্রতারক চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পরে। ভিকটিম প্রতি প্রতারণার জন্য ২৫ শতাংশ অর্থ সোনিয়াকে দেওয়া হতো। সোনিয়া আক্তারের নিজের নামে দক্ষিণখানে একটি চারতলা বাড়ি এবং একটি প্রাইভেট কার রয়েছে।’ 

র‍্যাবের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘প্রতি মাসে সোনিয়া ও নাহিদুল নাইজেরিয়ান নাগরিক রুবেনের সঙ্গে উত্তরার জসিমউদ্দীন এলাকায় প্রতি মাসে দুই-তিন বার দেখা করত। গত এক বছরে তারা ৩০ থেকে ৩৫ জনের সঙ্গে প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাৎ করেছে বলে স্বীকার করেছে।’ গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানান তিনি।
 


   আরও সংবাদ