ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ ভাদ্র ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

করোনাভাইরাস নিয়ে গুজবে বাঙ্গালি


প্রকাশ: ৭ এপ্রিল, ২০২০ ১৪:০০ অপরাহ্ন


করোনাভাইরাস নিয়ে গুজবে বাঙ্গালি

   

খাদিজা জাহান তান্নি : "মুখে মাস্ক হাতে স্যানিটারাইজার, শোবার রুমে ব্লিচিং স্প্রে, খাবার পানি গরম,-করোনা আমায় ছুঁতে পারবে না"-আমাদের বর্তমান অবস্থা ঠিক এমনই। আমরা স্বভাবতই গুজবে বাঙালি। যা বুঝি তা আরো বাড়িয়ে বলি, যা বুঝিনা তা বানিয়ে বলি। ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায় যে হোক তা সঠিক কিংবা বেঠিক। তার ফলশ্রুতিতে সমাজে সচেতনতার পরিবর্তে সৃষ্টি করি অসচেতনতা এবং আতংক।

আসুন আমরা জেনে নিই করোনাভাইরাস নিয়ে বিস্তারিত-
মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে পুরো পৃথিবী আজ স্তব্ধ। যুদ্ধের হুমকি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, রাজনীতি, অর্থনীতি সকল খবরাখবর যেন মুহূর্তেই থমকে গেছে। সারা বিশ্বে আজ একটাই খবর, সবার মনে একটাই ভয়, করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯)। Contagion মুভির মতো সারাবিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে ভাইরাসটি। 

প্রতিদিন অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়েই চলেছে করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যুহার। চীন, ইতালি, আমেরিকা, ইরান সহ বিভিন্ন দেশে চলছে যেন লাশের মিছিল।

কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস প্যান্ডামিক থেকে দেখা যায়, ২০২০ সালের ৭ এপ্রিল পর্যন্ত বিশ্বের ১৯০টির বেশি দেশ ও অধীনস্থ অঞ্চলে ১৩ লাখ ৮০ হাজার ২১১ জন এর বেশি কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত  হয়েছেন। এদের মধ্যে ৭৮ হাজার ২২৬ ব্যক্তির মৃত্যু এবং ২ লাখ ৯৫ হাজার ৭৬৪ জন রোগী সুস্থ হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত আক্রান্ত ১৬৪ জন, মৃত ১৭ জন এবং সুস্থ হয়েছেন ৩৩ জন।

কোভিড-১৯ এমন একটি করোনাভাইরাস যেটি মানুষের শরীরে প্রবেশ করে শ্বাসনালীর সংক্রমণ ঘটায়। এটি শুরুর দিকে চায়না ভাইরাস, নভেল করোনাভাইরাস, কোভিড-১৯ ইত্যাদি নামেও পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে বিশ্বস্বাস্থ্য  সংস্থা (WHO) ফেব্রুয়ারিতে আনুষ্ঠানিকভাবে এর নামকরণ করে।

কোভিড-১৯ (করোনাভাইরাস ডিজিজ-২০১৯)। এই ভাইরাসটি সর্বপ্রথম ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান নগরীর হুবেই প্রদেশে শনাক্ত করা হয়। পরবর্তীতে ২০২০ সালে এটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বস্বাস্থ্য  সংস্থা ২০২০ সালের ১১ই মার্চ এটিকে বৈশ্বিক মহামারী হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। সার্স (সিভিয়ার এ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) ভাইরাসের জেনেটিক কোডের সাথে মিলে যাওয়ায় অনেকে এটিকে সার্স (সার্সও একধরনের করোনাভাইরাস যা ২০০২ সালে চীন থেকে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়লে ৭৭৪ জনের মৃত্যু এবং ৮০৯৮ জন সংক্রমিত হয়েছিল) তুলনা করেন।

করোনাভাইরাসের উপসর্গ-
জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, গলাব্যথা এবং অবস্থা যত গুরুতর হবে তত জ্বর- শ্বাসকষ্টমূলক লক্ষন প্রকাশ পাবে। সাধারণত ৫ দিনের ভিতর প্রকাশ পায়। তবে ৮-৯ দিনও লাগতে পারে। এজন্য ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হয়।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের উপায়-
করোনাভাইরাস নাক, মুখ, চোখ দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে শ্বাসযন্ত্রে আক্রমণ করে। এই ভাইরাসটি মূলত সংক্রমিত হয় আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে। আক্রান্ত ব্যক্তি যখন হাঁচি বা কাশি দেয় তখন বাতাসে লক্ষ লক্ষ শ্লেষ্মাকণা ভাসতে থাকে, নিকটবর্তী ব্যক্তি শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে কণাগুলো ভিতরে প্রবেশ করে সংক্রমণ ঘটে। তাছাড়া হাঁচি বা কাশির ফলে ভাইরাসগুলো প্বার্শবর্তী পৃষ্ঠের বা দরজার শক্ত হাতল, লিফটের বাটন ইত্যাদির উপর আটকে থাকে, আরেকজন ব্যক্তি তা স্পর্শ করে মুখে হাত দিলে ঐ ব্যক্তিও ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যায়। 

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন থেকে বলা হয়েছে, এই ভাইরাসটি যেখানে লেগে থাকে,সেই জায়গাটি স্পর্শ করে মুখে হাত দেয়া মাত্রই ঐ ব্যক্তি সংক্রমিত হয়।

কোভিড-১৯ এর জীবাণু কতক্ষণ বেঁচে থাকে তা নির্ভর করে ভাইরাস কণাগুলো কোথায় কোথায় 

লেগে আছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, কাপড় জাতীয় কোনো বস্তুতে এটি বেশিক্ষণ বাঁচতে পারে না। আবার যদি স্টিল জাতীয় বস্তুতে পড়ে তবে ২/৩ দিন বেঁচে থাকতে পারে।

প্রতিরোধের উপায়-
এখনও পর্যন্ত করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। তবে চিকিৎসকদের পরামর্শ এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে কিছু নিয়ম মেনে চললে এটি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।

১) সুস্থ শরীরে রোগ বাসা বাঁধতে পারে না। চিকিৎসক এবং পুষ্টি বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের শরীরে যখন রোগ প্রতিরোধ কমে যায় তখন সামান্য অসুস্থ তাতেও দূর্বল হয়ে পড়ে এবং রোগের আক্রমণ আরও জোরালো হয়। তাই ভিটামিনযুক্ত খাবার বেশি করে খেতে হবে।
২) ধূমপান, কোমল তরল জাতীয় খাবার চা, কফি ইত্যাদি পরিহার করতে হবে।
৩) জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে।
৪) হ্যান্ডশেক বা কুলাকুলি থেকে বিরত থাকা।
৫) যথাসম্ভব ঘরে অবস্থান করা। বিশেষ প্রয়োজনে বের হলে মাস্ক পরিধান করতে হবে।
৬) কোনো কিছু  স্পর্শ করলে হাত স্যানিটারাইজার দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে।
৭) নাক, মুখ, চোখে বারবার হাত দেয়া পরিহার করতে হবে।
৮) করোনাভাইরাসে আক্রান্তের লক্ষণ দেখা দিলে ঘোরাফেরা বা না-ঘাবড়িয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে 'হোম কোয়ারন্টাইনে' যেতে হবে।
৯) সমাজের সকল স্তরের মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
১০)সরকার,বিভিন্ন সংঘটন,কিংবা উচ্চব্যক্তিবর্গ অসচ্ছল,মধ্যবিত্ত পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে।
১১)আক্রান্ত এলাকা দ্রুতসম্ভব লকডাউন করতে হবে।
১২) যেকোনো দূর্যোগে মানসিক মনোবল সবচাইতে বেশি প্রয়োজন। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে মানসিক মনোবল ঠিক রাখতে হবে।

করোনাভাইরাস নিয়ে আমাদের কিছু ভ্রান্ত ধারণা ও উত্তর-

১) মাস্ক পড়লেই করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। সুতরাং মাস্ক পড়ে বাইরে ঘুরাঘুরি করলেও কিছু হবে না। ধারণাটি একদম ভুল।করোনাভাইরাস প্রতিরোধে মাস্ক যথেষ্ট নয়।

এ প্রসঙ্গে The Centers for Disease Control and Prevention (CDC)  বলেছে, CDC does not recommend that the general public wear N95 respirators or surgical mask(Face mask).CDC always recommends everyday preventive actions, such as hand washing, to help prevent the spread of respiratory diseases. N95 এর 

বিষয়ে আরোও বলেছে, For the general American public, there is no added health benefit to wear a respiratory protective device (such as an N95 respirator), and the immediate health risk from COVID-19 is considered low.

২) থানকুনি, ডালচিনি,এলাচি এইগুলা খেলে করোনা আক্রমণ করতে পারে না। ধারণাটি ভুল। এইগুলা শরীরের জন্যে উপকারী কিন্তু করোনার প্রতিষেধক নয়।
৩) করোনাভাইরাস বায়ুবাহিত রোগ। এটি বাতাসের মাধ্যমে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গিয়ে মানুষের মাঝে সংক্রমণ ঘটায়। ব্যাপারটি এমন নয়।

শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহন কিংবা  পৃষ্ঠে লেগে থাকা ভাইরাস কণাগুলা হাত দিয়ে  স্পর্শ করলেই আক্রান্ত হয় না যতক্ষন না পর্যন্ত হাত দিয়ে মুখ, নাক বা চোখ স্পর্শ করে।
৪) জ্বর, শ্বাসকষ্ট শুনলেই ধরে নিয়ে। তাই এমন লক্ষন থাকলেও বলা যাবে না। এই ভাবনা মাথায়-ই আনবেন না। আপনি আক্রান্ত না হলে বাসায় চলে আসতে পারবেন কিন্ত আক্রান্ত হয়ে লুকিয়ে থাকলে আপনার জন্যে যেমন ক্ষতিকর তেমনি আশেপাশের মানুষের জন্যেও মারাত্মক ক্ষতিকর।
৫) সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো নিউজ সত্য মিথ্যা যাচাই না করে আতংকিত হবেন না।

সুতরাং গুজব কিংবা ভ্রান্ত ধারণা থেকে বের হয়ে সঠিক তথ্য, সতর্কতা অবলম্বন, সচেতনতা সৃষ্টি এবং প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা মেনে চলে সবাই একযোগে কাজ করলে এই মহামারী থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব হবে।

খাদিজা জাহান তান্নি, অধ্যায়নরত
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। 


   আরও সংবাদ