ঢাকা, রবিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩ চৈত্র ১৪৩২, ১৬ জ্বমাদিউল সানি ১৪৪৭

সিনেমাটিক স্টাইলে গুলি করে 'শীর্ষ সন্ত্রাসী' মামুনকে হত্যা

আদালত থেকে ফেরার পথে হত্যা

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর, ২০২৫ ০৯:০৫ পূর্বাহ্ন


সিনেমাটিক স্টাইলে গুলি করে 'শীর্ষ সন্ত্রাসী' মামুনকে হত্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক: পুরান ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজিরা দিয়ে বের হয়ে ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতালের সামনে পৌছালে শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে (৫৫) লক্ষ্য করে সিনেমাটিক স্টাইলে গুলি ছোড়ে সন্ত্রাসীরা। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন মামুন। 

আজ সোমবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে তাকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ বলছে, খুব কাছ থেকে তাকে এলোপাতারি গুলি করে দুর্বৃত্তরা। কয়েক সেকেন্ডে ৬ রাউন্ড গুলি করে সন্ত্রাসীরা। গুলি লেগে পড়ে যাওয়ার পরও মৃত্যু নিশ্চিত করতে কাছ থেকে আবারও গুলি করে তারা।

পুলিশ বলছে, নিহত ব্যক্তি শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের সহযোগী ছিলেন। তবে অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল। এর আগে ২০২৩ সালে তেজগাঁও বিজিপ্রেস এলাকায় একবার ইমনের নিশানায় পরিণত হয় মামুন। তবে সেবার প্রাণে বেঁচে গেলেও সেদিন সন্ত্রাসীদের গুলিতে প্রাণ হারান পথচারী ভুবন চন্দ্র শীল নামে এক আইনজীবী।

নিহতের খালাতো ভাই হাফিজ বলেন, ভাই তারিক সাইফ মামুনকে কী কারণে তাকে হত্যা করা হলো জানি না। তিনি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না। কারা তাকে হত্যা করেছে, কী কারণে করেছে জানা নেই। আমরা এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।

জানা গেছে, শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন ও তারিক সাঈফ মামুন একসময় ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর ও তেজগাঁও এলাকার আতঙ্ক এবং পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী ছিলেন। তাদের গড়ে তোলা বাহিনীর নাম ছিল ‘ইমন-মামুন’ বাহিনী। তারা দুজনই চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী ও সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাই সাঈদ আহমেদ টিপু হত্যা মামলার আসামি। গতকাল তিনি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২ এ একটি মামলায় হাজিরা দিতে বাসা থেকে বের হন। সকালে দ্রুত বিচার মামলা ৩৫/২০০৩ এ তিনি আদালতে হাজিরাও দেন।

একটি সূত্র বলছে, চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলায় ২০ বছর সাজা খেটে ২০২৩ সালে কারামুক্ত হন মামুন। এর তিন মাসের মাথায় ওই বছরের সেপ্টেম্বরে রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার বিজি প্রেসের সামনে তার ওপর হামলা চালায় আরেক ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ সানজিদুল ইসলাম ইমনের সহযোগীরা বলে জানিয়েছিল তৎকালীন পুলিশ কর্মকর্তারা।

আদালত সূত্রে জানা যায়, জাহিদ আমিন ওরফে হিমেলকে ১৯৯৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে মোহাম্মদপুর পিসি কালচার হাউজিং এলাকায় গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। সেদিন হিমেলের বন্ধু মামুনও আহত হন। এ ঘটনায় হিমেলের মা জাফরুন নাহার সাতজনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও ২/৩ জনকে আসামি করে মামলা করেন। মামলার তদন্ত শেষে ওই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর মামুনসহ ৬ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অপর আসামিরা হলেন- ওসমান, মাসুদ ওরফে নাজমুল হোসেন, রতন, ইমন ও হেলাল। ওই মামলার হাজিরা দিতে গতকাল আদালতে যান নিহত মামুন।

নিহতের পরিবার বলছে, দুই বছর আগে রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় উঠেন তারা। গতকাল আদালতে হাজিরা দিতে তিনি সকালে বাসা থেকে বের হন। মামুনের স্ত্রী বিলকিস আক্তার গণমাধ্যমকে বলেন, তারা ধারণা শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের লোকজন এই হত্যার সঙ্গে জড়িত। এর আগেও ইমনের লোকজন মামুনকে হত্যার চেষ্টা করে।

হত্যাকাণ্ডের পর নিহত মামুনকে ব্যবসায়ী হিসেবে দাবি করেন তার স্বজনরা। তবে পুলিশ বলছে, মামুনের অতীত অপরাধের বহু রেকর্ড রয়েছে। এছাড়া পুলিশের খাতায়ও তিনি শীর্ষ সন্ত্রাসী। ২০২৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আদালতে হাজিরা দিতে গেলে ইমন তাকে ‘দেখে নেওয়ার' হুমকি দেন।

এ ঘটনায় নিহত মামুনের আইনজীবী মেহেদী হাসান জানান, তিনি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক মমিনুন নেসার আদালতে হাজিরা দেন। ১৯৯৭ সালের একটি হত্যা মামলায় সাক্ষীরা কেউ আসে না। আদালতকে মামলা শেষ করার জন্য বলি। পরে আদালত আগামী বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী দিন ধার্য করা হয়। মামুন কেন হাসপাতালে গিয়েছিলেন জানতে চাইলে বলেন, এটা তো বলতে পারব না।

ডিএমপির লালবাগ বিভাগ উপ-কমিশনার মল্লিক আহসান উদ্দিন সামী বলেন, ‘নিহত ব্যক্তি ইমন গ্রুপের শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন। নিহত মামুন চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী এবং সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাই শহীদ সাঈদ আহমেদ টিপু হত্যা মামলার আসামি। একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবেই পুলিশের খাতায় তার নাম রয়েছে। তার হত্যার পেছনে কার হাত রয়েছে, সেই বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। দ্রুত অপরাধীদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হবে।

কোতোয়ালি থানায় পুলিশের এসআই ইয়াসিন বলেন, গুলির শব্দ শুনতে পেয়ে ন্যাশনাল হাসপাতালের সামনে এসে দেখি অজ্ঞাত এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছেন। খুব কাছ থেকে তাকে গুলি করা হয়।

ঢামেকে পরিবারের আহাজারী
সরেজমিনে দুপুর ১টার দিকে ঢামেক হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে গিয়ে দেখা যায়, মামুনের নিথর দেহে জড়িয়ে ধরে আহাজারি করছে দুই নারী। পরে জানা যায়, একজন মামুনের স্ত্রী বিলকিস আক্তার ও অপরজন তার মেয়ে। লাশ জড়িয়ে ধরে মেয়ের আহাজারিতে আকাশ–বাতাস ভারি হয়ে উঠে। পুলিশকে লক্ষ্য করে মেয়েকে বলতে শোনা যায়, আঙ্কেল আমার বাবাকে কী ফিরিয়ে দিতে পারবেন?। আমার বাবাকে ফিরিয়ে দেন না। অনেকদিন আমার বাবা বাসা থেকেই বের হতো না। আজকে আদালতে আসতে দিয়েই তাকে হারিয়ে ফেললাম।

ভিডিও ফুটেজের বর্ণনা
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, সকাল ১০টা ৫১ মিনিটের দিকে হাসপাতালের দিক থেকে হাতলম্বা গেঞ্জি ও কালো প্যান্ট পরিহিত এবং বা হাতে মোবাইল তারিক সাইফ মামুন বের হচ্ছেন। এর কয়েক মিনিট পর দুর্বৃত্তরা ছোড়া গুলি থেকে বাঁচতে তিনি আবার হাসপাতালের দিকে দৌড়ে আসছেন। তার পেছনে মাথায় ক্যাপ, মুখে মাস্ক, গায়ে শার্ট ও পরনে জিন্স প্যান্ট দুই ব্যক্তি তাকে লক্ষ করে ফ্ল্যিম স্টাইলে গুলি ছুড়ছেন। এরপর তারা একসঙ্গে অস্ত্রে গুলি লোড করে আবার গুলি ছোড়া শুরু করে। এর মধ্যে একজন দাঁড়িয়ে কোমরে অস্ত্র লুকানোর চেষ্টা করছেন। অন্যজন্য তখনও মামুনের পিছু নিয়ে গুলি ছুড়ছেন। মিনিটখানেক পর ফিরে এসে দুজনে একসঙ্গে পালিয়ে যায়। পুরো বিষয়টি দাঁড়িয়ে দেখছিলেন এক নিরাপত্তাকর্মী।

আরেকটি ফুটেজে দেখা যায়, হাসপাতালের দরজায় সামনে মামুন মুখসাপড়ি দিয়ে পড়ে রয়েছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার শরীর। ওই অবস্থা দেখে দুজন পথচারী হাসপাতালের টলি ডাকছেন। এ সময় দুজন নিরাপত্তাকর্মীসহ অন্যরা ধরাধরি করে তাকে টলিতে তুলে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। এ সময় মামুনের তার সারা শরীর রক্তে ভিজে গেছে, তার কোনো নড়াচড়া নেই। ইমারর্জেন্সীর সামনে তাকে একজন ডাক্তার ও নার্সেরা দৌড়ে আসেন। তারা পর্যাবেক্ষণ শুরু করেছে। তার কিছু সময় পর তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসা হয়।

প্রত্যাক্ষদর্শীর বর্ণনা
স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান সমকালকে বলেন, যে মারা গেছে সে খুব দ্রুত গতিতে হাসপাতালের মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করেন। পেছন থেকে গুলি করা মানুষেরা দ্রুত গতিতে সামনের জনের তাড়া করে। গেটের সামনেই তাদের ছোড়া গুলিতে পড়ে যায়। এ সমায় তারা কাছে গিয়ে গুলি করে। তিনি বলেন, গুলি করা দুজনই লাল–কালো রঙের একটি মোটরসাইকেল থেকে নেমে গুলি করা শুরু করেন। হাসপাতালের গেটে নিরাপত্তাকর্মীরা ছিল। গুলির আওয়াজ শুনে সবাই এদিক–সেদিক ছোটাছুটি করছিল। প্রথম যখন গুলি করে, সে রাস্তার ওপর থেকে দৌড় ন্যাশনাল মেডিকেলের দিকে এগিয়ে আসতেছিল। গেট থেকে দু–তিন ফুট সামনে গিয়ে পড়ে যায়।

প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুল মান্নান সমকালকে বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসি। ফেরার পথে একজন আত্নীয়ের জন্য হাসপাতালে সামনে রাস্তার পাশে অপেক্ষা করছিলাম। এসময় দেখি একটা লোক দৌড়ে হাসপাতালের দিকে আসছেন। পেছন থেকে দুজন মোটরসাইকেল থেকে নেমে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে ছুড়তে আসছে। প্রথম গুলি হাসপাতালের ওপরের দিকে করেন। ৫–৬টি গুলি ছুড়েছে দুজন। এরপর ওই ব্যক্তি পড়ে যায়। তখন একজন তার কাছে গিয়ে আরও দুটো গুলি করে।

ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেলের সিকিউরিটি গার্ড মো. তালহা বলেন, দুইজন লোক প্রথমে এলোপাতাড়ি গুলি করে। গুলি প্রথমে পায়ে লাগে লোকটি পরে যাওয়ার পর আবার ৩–৪ টা গুলি করে লোকগুলো পালিয়ে যায়। 

হাসপাতালের ওয়ার্ডমাস্টার মো.মহিবুল্লাহ জানান, বেলা ১১টার দিকে হঠাৎ হাসপাতালের সামনে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। পরে শব্দ শুনে সবাই হাসপাতালের প্রধান দরজার সামনে এসে সাইফ মামুন নামের ওই ব্যক্তিকে রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেন। তাকে উদ্ধার করে প্রথমে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। তবে অবস্থার অবনতি হতে থাকলে সেখান থেকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়।


   আরও সংবাদ