ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ ভাদ্র ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

ফোকলোর' ও বাংলা, দুই অসম মেরুর সমীকরণ


প্রকাশ: ২ অক্টোবর, ২০১৯ ১৪:০০ অপরাহ্ন


ফোকলোর' ও বাংলা, দুই অসম মেরুর সমীকরণ

   

প্রিন্স আহেমদ (ঢাবি) : "ব্যবসায়ীদের পঠন নিয়ে, সাহিত্যিকের ভান করে, শেষে ফোকলোর পায় বাংলার সম্মান! ইউ.জি.সি. রাঁধেন বাড়েন, রাবি ফোকলোর খান- বাংলা বিভাগ ঝোলা হাতে কার দুয়ারে যান?"

লোক সংস্কৃতির অংশ লোক ছড়াকেই 'প্যারোডি' করে লেখাটা শুরু করলাম। 

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন খেয়ালবশে হঠাৎই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সমাজ বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত  'ফোকলোর' বা 'লোক সংস্কৃতি' বিভাগ এখন থেকে সনদে এবং কর্মক্ষেত্রে বাংলা বিভাগের সমমান এবং সমসুবিধাপ্রাপ্ত হবে। 

বিজ্ঞ মঞ্জুরী কমিশনের এ হেন সিদ্ধান্তের সঙ্গত কারন নির্দেশ করা না গেলেও ধারনা করা যায়, নতুন বিভাগ হিসেবে আসা 'ফোকলোর'-এর শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক কর্মক্ষেত্রের অনুপস্থিতিই প্রধান কারন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে 'ফোকলোর' বিভাগে পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা রয়েছে। 

বিষয়ভিত্তিক পদ সৃষ্টিই যদি 'ফোকলোর'-কে বাংলার সমমান করার একমাত্র কারন হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে- কলা অনুষদভুক্ত- আরবি, ফারসি, পালি, সংস্কৃত, উর্দু, সংগীত, নাট্যকলা(চারুকলা অনুষদভুক্ত), নৃত্যকলা, ভাষাবিজ্ঞানসহ শিক্ষা ও গবেষণা অনুষদও মঞ্জুরী কমিশনের সুদৃষ্টি আশা করতে পারে। সেক্ষেত্রে- প্রশ্ন দাঁড়ায়, "সংস্কৃত বাংলার জননী", "আরবি-ফারসি বাংলার মাসি-পিসি", "উর্দু বাংলার সৎ-ভাই"- প্রভৃতি সূত্র সহযোগে এ সকল বিভাগকেও বাংলার আত্তীকৃত করা হবে কিনা।

'ফোকলোর'কে বাংলার সমমান করার পিছনে যদি যুক্তি দাঁড় করানো যায়, বাংলা বিভাগে লোক সাহিত্য (Folk literature) পড়ানো হয়, ফোকলোরেও পড়ানো হয়, তাহলে- মঞ্জুরী কমিশনের যুক্তিটি অনেকটা এমন শোনাবে, ইসলাম শিক্ষা বিভাগে কম্পিউটার পড়ানো হয়, অতএব তাদের কম্পিউটার ও সফটওয়্যার প্রকৌশল (CSE) বিভাগে আত্তীকৃত করা হোক! কেননা, 'ফোকলোর' বিভাগের পাঠ্যসূচীতে ১০৩ সংখ্যক কোর্সে 'বাংলা সাহিত্যের রূপরেখা: প্রাচীন ও মধ্যযুগ" ছাড়া আর কোন অংশে বাংলা বিভাগের পাঠ্যসূচীর ছিটে-ফোটাও নেই। 

যেখানে, সরকারি চাকরীপ্রত্যাশীরা এই কোর্সের বিষয়বস্তুর সাথে সম্পূরক হিসেবে আধুনিক বাংলা সাহিত্যও পড়ে থাকে, সেখানে- বাংলার সাহিত্যতত্ত্ব, সমালোচনাতত্ত্ব, প্রায়োগিক সমালোচনা ও গবেষণা করা শিক্ষার্থীদের বিপরীতে 'ফোকলোর'-এর শিক্ষার্থীদের সমমানের সনদ দেওয়া যায় কিভাবে? উপরন্তু, বাংলা বিভাগের সংশ্লিষ্ট পদ পদ হলো- শিক্ষকতা। যেখানে, দেশের বুদ্ধিজীবী মহলে বাংলেদেশ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার মাধ্যমে পঠিত বিষয়ের সাথে সম্পর্কহীন পদে নিয়োগের ব্যাপারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে, সেখানে, শিক্ষকতার মত (তাও, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের মতো গুরুত্বপূর্ণ শ্রেনীতে) একটি সংশ্লিষ্ট জ্ঞান নির্ভর পেশায়, বিষয় সম্পর্কিত জ্ঞানবিহীন ব্যক্তিদের কিভাবে নিযুক্ত করা যেতে পারে তা সম্পূর্ণই প্রশ্নবিদ্ধ। 

উল্লেখ্য- ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে মঞ্জুরী কমিশন অবিবেচকের মতো ভাষাবিজ্ঞানকে একই রকম সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করলে, বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদেরর মুখে সে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয়। পাঁচ বছর পর মঞ্জুরী কমিশনের আবারও এমন অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তে ঘুষখোর সেই ট্রাফিক পুলিশের গল্পটি মনে পড়ে যায়-

হেলমেটবিহীন এক কলেজ ছাত্র ট্রাফিক সার্জেন্টের কাছে ধরা পড়লে, সার্জেন্ট তার কাছে পাঁচশত টাকা দাবি করে। ছাত্র জানায় পাঁচশত টাকা নেই, সার্জেন্ট আস্তে আস্তে একশত, পঞ্চাশ, বিশ, দশ টাকা দাবি করে যখন জানতে পারে ছাত্রটির পকেটে আদতে একটি পয়সাও নেই, তখন সে নির্লজ্জের মতো বলে, "তাইলে, পিঠটা চুলকাইয়া দিয়া যা"!

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের প্রথমে ভাষাবিজ্ঞান, তারপর, 'ফোকলোর' সেই পাঁচশত, একশত, পঞ্চাশ, বিশের মতো মনে হচ্ছে, এখন ভয় হয়- শেষে না ইউ.জি.সি. পিঠই চুলকে দিতে বলে! উন্নয়নশীল এই দেশে বেকারত্বের হার যেমন আশঙ্কাজনক, নতুন পদ সৃষ্টির প্রচেষ্টা তেমন নয়। কোন বিভাগে পড়ার আগ্রহ বা দেশকে উন্নত করতে হলে এক বিষয়ে পড়া-লেখা করা ব্যক্তিকে অন্য বিষয়ের কর্মক্ষেত্রে নিয়োগ দেওয়া কোন সমাধান নয়, বরং- জটিলতাই তাতে বৃদ্ধি পায়। আমাদের উচিত হবে এ ধরনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত না নিয়ে, 'ফোকলোর'-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলোর দক্ষতাপরিধী অনুযায়ী নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করা, আর তাতেই দেশ ও দশের মঙ্গল। শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।

লেখকঃ প্রিন্স আহেমদ
স্নাতকোত্তর (এম.এ)
বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


   আরও সংবাদ